সেই ভয়, সেই অনিশ্চয়তা আবার? ছবি: দেবরাজ ঘোষ
অমিত শাহ ও সীতারাম ইয়েচুরি থ হয়ে যেতে পারেন কথাটা শুনলে। অবিশ্বাস করতে পারেন, অসত্য বলে উড়িয়েও দিতে পারেন। কিন্তু এক ব্যক্তি একই সঙ্গে বিজেপি ও সিপিএম! আর এটাই ঘোর বাস্তব।
এ বছরও সিপিএমে নিজের সদস্যপদ নবীকরণ করিয়েছেন, এমন এক জন নিজের গ্রামে বিজেপি-র হয়ে প্রচারে মুখ্য ভূমিকায়।
ঝাড়গ্রাম জেলা, নয়াগ্রাম এলাকা, বালিগেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। গ্রামের নাম বাঁশকুঠি। অচিন্ত্য নায়েকের সাফ কথা, ‘‘এমনিতে আমি সিপিএম-ই। কিন্তু এখন বিজেপি করছি। শুধু তৃণমূলকে হটানোর লক্ষ্যে।’’
কৃষক অচিন্ত্য একা নন, ছোট চায়ের গুমটি চালানো চিত্রেশ্বর দাস-সহ গ্রামের ১৩ জনের রাজনৈতিক অবস্থান এখন ওই রকম। একই দেহে লাল-গেরুয়া। শাসক দলের বিরোধিতার ‘অপরাধে’ গত পাঁচ বছরে এক দিনও ১০০ দিনের কাজে সামিল হতে পারেননি, এমনই অভিযোগ তাঁদের সবার।
আসলে এই পরিস্থিতিতে এখানে বিজেপি করা কোনও রাজনৈতিক দলে নাম লেখানো বা সেই দলের মতাদর্শ অনুসরণ নয়। বিজেপি করা মানে রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের বিরুদ্ধাচরণ করার একটা পোক্ত মঞ্চ। সেটা আরও স্পষ্ট হল লালগড়ে মাওবাদীদের সহযোগী, ‘পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি’-র সক্রিয় সদস্য থাকা এক যুবকের কথায়। আন্দোলনের তপ্ত সময়ে সেল্ফ লোডিং রাইফেল কাঁধে ওই তল্লাটে ঘুরতে দেখা যেত আর এখন বিজেপি-র হয়ে তলে তলে প্রচার চালানো ওই যুবক বললেন, ‘‘কমিটির সদস্যদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে। দুর্নীতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হলেই পুলিশ দিয়ে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এখন একমাত্র বিজেপি-র কাছেই আশ্রয় পাওয়া যাবে। কারণ, তারা কেন্দ্রে ক্ষমতায়।’’
ন’বছর আগে আন্দোলন শুরু হয় সিজুয়া বা কাঁটাপাহাড়ির দলিলপুর চকে। ৫ নভেম্বর ঝাড়গ্রামে বিজেপি-র জেলা কার্যালয় উদ্বোধনের দিন সভায় যোগ দিতে এক বাস ভর্তি লোক গিয়েছিল সিজুয়া থেকে।
জনসাধারণের কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও গ্রাম সুরক্ষা স্কোয়াডের সচিব ছিলেন যিনি, সিজুয়া গ্রামের যুবক সেই কিঙ্কর সিংহ বলেন, ‘‘তৃণমূলের একাধিপত্য এখন কমেছে। ধীরে ধীরে বিরোধী শক্তির উত্থান হচ্ছে। তবে সিপিএম, ঝাড়খণ্ড পার্টির অস্তিত্ব নেই। জনসাধারণ অন্য কিছু ভাবছে।’’ আর এই ‘অন্য কিছু’-টাই হল বিজেপি। কমিটির সদস্য ছিলেন, এমন একাধিক যুবকের কথায়, ‘‘তৃণমূলের সঙ্গে লড়তে গেলে বিজেপি হওয়া ছা়ড়া উপায় নেই।’’
কিন্তু মাওবাদীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার সুবাদে যাঁরা একদা অতি বাম মতাদর্শের কাছাকাছি ছিলেন, এখন বিজেপি-র হয়ে প্রচার করতে তাঁদের অস্বস্তি হচ্ছে না?
কমিটির প্রাক্তন শীর্ষনেতা কিঙ্কর সিংহের যুক্তি, ‘‘মাওবাদীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। আর গণতন্ত্রে যা করা উচিত, জনসাধারণ এখন তেমনই পদক্ষেপ করছেন।’’
কমিটির আর এক প্রাক্তন নেতার কথায়, ‘‘আমরা আঞ্চলিক রাজনীতি করছি। বিজেপি-ই এখানে প্রাসঙ্গিক।’’ তবে লালগড়ে বিজেপি-র সাংগঠনিক অস্তিত্ব অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখেও চোখে পড়ে না। তা হলে? এ ক্ষেত্রে কিঙ্করের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘প্রকাশ্য কর্মসূচি নেই ঠিকই, তবে তলে তলে জনসাধারণ কী ভাবছেন, সেটা তাঁরাই জানেন।’’
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, তাঁদের সঙ্গে লালগড় ও আশপাশের তল্লাটের কয়েক জন যোগাযোগ রাখছেন। দিলীপবাবুর কথায়, ‘‘কমিটির সদস্য ছিল, এমন কিছু লোক আমাদের দিকে আসবেই। ওরা রাজনৈতিক আশ্রয় চায়, কিছু করতে চায়।’’
তবে লালগড়ে কমিটির প্রাক্তন নেতা ও সদস্যদের একাংশ অন্য রকম কিছু চাইছেন। তাঁদের ভাবনা, বিজেপি একটু শক্তিশালী হলেই মাওবাদীরা ফের ঢুকবে। এবং সেই মতো নাকি কথা হয়ে আছে! আর সেই জন্যই কি ৯ নভেম্বর নয়াগ্রামের ওড়িশা লাগোয়া গ্রাম ধুমসাইয়ে সাদা কাগজে লাল কালি দিয়ে বাংলা হরফে লেখা মাওবাদী পোস্টার পড়েছিল পঞ্চায়েতে দুর্নীতির প্রতিবাদ করে! মোটর সাইকেলে চড়ে তিন জন এসেছিল পোস্টার সাঁটতে আর সবার মুখ ছিল হেলমেটে ঢাকা। আড়ালে কি তাঁরাই, যাঁরা সামনে বিজেপি, কিন্তু আসলে অতি বামপন্থী!
দিলীপ ঘোষ অবশ্য বলছেন, ‘‘কয়েক জন গোলমাল পাকাতে চেষ্টা করবে। তবে আমরা আটকাব।’’
কিন্তু বালিগেড়িয়ার গড়দুয়ারা গ্রামের রতিকান্ত মাহাতো, বেদঝরিয়া গ্রামের বিভূতি মাহাতোদের কথায়, ‘‘মাওবাদীরা আমাদের মতো গরিব মানুষের ভাল করতেই এসেছিল। আমরা এখন খুব খারাপ আছি।’’
শান্ত কংসাবতীতে, তার মানে, ফের চোরাস্রোত।
(শেষ)