সব্যসাচী দত্ত ও সুজিত বসু।
শাসক দলের অন্দরের কোন্দল বারবার প্রকাশ্যে এসে পড়ছে বিধানসভায়! শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বনাম অরূপ বিশ্বাস দ্বন্দ্বের রেশ মিটতে না মিটতেই এ বার সব্যসাচী দত্ত বনাম সুজিত বসু। এবং নেপথ্যে সেই সিন্ডিকেট, প্রোমোটারি-রাজের কাহিনি!
রাজারহাটের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী অবশ্য দলের কোনও নেতার নাম করে কিছু বলেননি। কিন্তু বিধানসভা অধিবেশনের উল্লেখ-পর্বে বুধবার লেকটাউনের একটি নালা বোজানোর প্রসঙ্গ তুলে তিনি কৌশলে বিধাননগরের দলীয় বিধায়ক সুজিতকেই প্রোমোটারি-রাজের সঙ্গে জড়াতে চেয়েছেন বলে শাসক শিবিরের ব্যাখ্যা। কলকাতার উপকণ্ঠে সিন্ডিকেট এবং এলাকায় কর্তৃত্ব বজায় রাখা নিয়ে শাসক দলের ওই দুই বিধায়কের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের। বছরখানেকের মধ্যেই বিধানসভা ভোট। আর তারও আগে বিধাননগর ও রাজারহাট এলাকার পুরসভাকে সংযুক্ত করে পুর-নিগমে রূপান্তর ঘটিয়ে ভোট হওয়ার কথা। এই পরিস্থিতি সব্যসাচী-সুজিতের বিরোধ স্বভাবতই উদ্বেগে ফেলছে শাসক দলকে। দুই বিধায়ককে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিষদীয় মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। শাসক দলের অস্বস্তি বাড়িয়ে বিধানসভায় তাদের খোঁচা দিতে ছাড়ছেন না শমীক ভট্টাচার্যের মতো বিরোধী শিবিরের বিধায়কেরা!
বিধানসভার উল্লেখ-পর্বে এ দিন সব্যসাচী অভিযোগ করেন, ভিআইপি রোডে উল্টোডাঙার পরের বাসস্টপ গোলাঘাটা থেকে লেকটাউন পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার বিস্তৃত পূর্ত দফতরের একটি খাল জবরদখল হয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে পূর্ত দফতর যাতে ব্যবস্থা নেয়, সেই দাবিও তোলেন তিনি। সব্যসাচীর অভিযোগ যে এলাকা নিয়ে, তা সুজিতের বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। পরে সভার বাইরে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে সব্যসাচী বলেন, ‘‘পুরো খালটাই বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। আমাকে অনেকেই বলছেন সত্যিটা বলে দিতে!’’ কোন সত্যির কথা তিনি বলতে চাইছেন? নালা বোজানোর পিছনে রাজনৈতিক মদত? রাজারহাটের বিধায়কের জবাব, ‘‘মদত আছে কি না, বলছি না। তবে রাজনৈতিক মদত না থাকলে কি এ সব হয়?’’ সব্যসাচীর হিসেব, ‘‘ভিআইপি রোডের ধারে এখনই এক কাঠা জমির দাম ৩০-৩৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু নয়ানজুলিটা বুজিয়ে ভিআইপি-র সঙ্গে সংযোগ করে ফেলতে পারলে আশপাশের জমির দাম এক থেকে দেড় কোটি টাকা হবে! তা হলেই বুঝতে পারছেন, কেন খাল বোজানোর দরকার হয়ে পড়েছে!’’ ভিআইপি রোডের পাশের নয়ানজুলি যে ‘অসাধু প্রোমোটারে’রা ভরাট করে ফেলছে, সেই কথা বিধানসভার পূর্ত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। পাশাপাশিই তাঁর দাবি, এই ব্যাপারে তিনি রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী ও স্পিকারকে চিঠি দিলে স্পিকারের দফতর থেকে তাঁকে জানানো হয়, ‘উপযুক্ত মঞ্চে’ বিষয়টি উল্লেখ করতে। তিনি সেটাই করেছেন।
বিধানসভার মধ্যে এর জবাব দেওয়ার সুযোগ সুজিতের ছিল না। পরে লবিতে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যাঁরা এ সব বলছেন, তাঁরা ওই এলাকা সম্পর্কে কিছু না জেনে বলছেন! ওখানে খাল নেই। রয়েছে আবাসিকদের নিকাশি নালা। পূর্ত দফতরই সেখানে কাজ করছে।’’ ওই ব্যাপারে আদালতের গ্রিন বেঞ্চে যে মামলা হয়েছিল, সেই ব্যাপারে তিনি অবহিত জানিয়ে সুজিতের আরও দাবি: ওই বেঞ্চের সুপারিশে যা আছে, সেই মর্মেই কার্যক্ষেত্রে পদক্ষেপ হচ্ছে। বিধাননগরের বিধায়কের ব্যাখ্যা: ‘‘ওই নালা থেকে দূষণ ছড়ায় বলে বাসিন্দারা আমার সাহায্য চান। তার ফলে দক্ষিণ দমদম পুর এলাকার উন্নয়নের কাজে জেএনএনইউআরএম থেকে ৬৬ কোটি টাকা নিয়ে এসে তার মধ্যে এই নালার উপরে ঢাকা দেওয়ার কাজও করাই। ওখানে জগার্স পার্ক, ফাউন্টেন ইত্যাদিও করছে পূর্ত দফতর।’’
সতীর্থ বিধায়কের প্রতি কটাক্ষ মিশিয়েই তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমার এলাকায় উন্নয়ন করি বলেই পুরভোটেও আমাদের ভোট বেড়ে গিয়েছে। কাজ করি বলেই জনপ্রিয়তাও বাড়ে। সিন্ডিকেট করে রোজগারের দরকার হয় না!’’ শুনে সব্যসাচী বলেছেন, ‘‘সভার ভিতরে পূর্ত দফতরের প্রতি প্রশ্ন করতে গিয়ে উল্লেখ করেছি। ওই দফতর জবাব দিলে দেবে। এই নিয়ে কে কী মন্তব্য করল, কিছু এসে যায় না! আমার যা বলার, তা বলবই!’’ সুজিত-সব্যসাচী এই কাজিয়ার মাঝেই অরূপ-শোভনদেব দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ এ দিন কায়দা করে বিধানসভায় তুলে দিয়েছেন বিজেপি বিধায়ক শমীক। জিরো আওয়ারে সরব হয়ে তিনি এ দিন শাসক দলকে বিঁধে বলেছেন, ‘‘দুর্দিনে যাঁরা তৃণমূল করেছিলেন, দেওয়াল লিখেছিলেন, তাঁরা এখন আক্রান্ত। শাসক দলের মূল দর্শনই হল, যো জিতা, ওহি সিকন্দর!’’ শমীকের আরও সংযোজন, ‘‘ভাই-ভাইপো, ভাগ্নে-ভাইঝি এরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! বিধানসভার প্রবীণ সদস্যেরাও আক্রান্ত হচ্ছেন।’’ দলের মধ্যে বিচার পাওয়ার বদলে বর্ষীয়ান শোভনদেব এখন অরূপের বিরুদ্ধে মুখ খুলে আরও কোণঠাসা। এমতাবস্থায় শমীকের মন্তব্যকে এ দিন তারিফই করেছেন শোভনদেবের ঘনিষ্ঠেরা।
প্রকাশ্যে মুখ খোলায় শোভনদেবকেই নিশানা করে আপাতত পার পেতে চেয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। নতুন অস্বস্তি নিয়ে তাঁদের সামনে হাজির সব্যসাচী-সুজিত দ্বন্দ্ব। ঘটনা হল, লেকটাউন এলাকার সমস্যা নিয়ে বিরোধীদের যে অভিযোগ করার কথা, অন্য এলাকা থেকে তৃণমূলেরই বিধায়ক কেন তা নিয়ে বিধানসভায় সরব হতে গেলেন— এই নিয়ে শাসক দলের অন্দরেই প্রশ্ন আছে। রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘সিন্ডিকেটের সঙ্গে আসলে বারবার সব্যসাচীর নাম জড়িয়েছে। উনি পাল্টা সুজিতকে প্রোমোটারির সঙ্গে জড়িয়ে দিলেন!’’