কঙ্কালসার চেহারাটা বেরিয়েই পড়ল সেই। সবটা যেন ফাঁপা, উপর উপর। ভঙ্গুর একটা প্রলেপে ঢাকা যেন। সেই প্রলেপটাও যেন জায়গায় জায়গায় খসে পড়তে শুরু করেছে। জোড়া দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে না, তা হয়তো নয়। কিন্তু সে চেষ্টাটাও দিনের শেষে জোড়াতালির মতো।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বুধবার অসংসদীয় ভাষায় আক্রমণ করা হল বামপন্থী বিধায়কদের। শাসকের অপশব্দের প্রতিবাদ করে বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট বামেদের। সংহতি দেখিয়ে ওয়াকআউট কংগ্রেসেরও।
এ পর্যন্ত সবটা ঠিকই ছিল। জোট অটুট রাখার বার্তাটা মজবুতই ছিল। কিন্তু এর পর কী হল? বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান দলীয় বিধায়কদের জানিয়ে দিলেন, বামেদের হয়ে কংগ্রেস ওয়াকআউট ঠিক হয়নি। অগত্যা ফের সভাকক্ষে ফিরলেন কংগ্রেস বিধায়করা। অংশ নিলেন অধিবেশনে।
কোন পরিস্থিতিতে এই ঘটনা ঘটল?
যখন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কংগ্রেস-সঙ্গের বিরুদ্ধে ঝড় উঠেছে এবং বাংলার সিপিএম পার্টি লাইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পথে হাঁটতে পারেনি বলে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে।
যখন প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি নিজের দলকে বার্তা দিয়েছেন, বামেদের প্রতি সংহতি দেখাতে গিয়ে বামেদের সঙ্গে নিজেদের গুলিয়ে ফেলা চলবে না।
অর্থাৎ, দলের নেতৃত্বের মধ্যে টানাপড়েন দেখে সাধারণ বাম-কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের মনে যখন জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় ঘনাতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই নেতারা আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিলেন, বিধানসভার অন্দরেও বিরোধী ঐক্যের দেওয়ালে বড়সড় ফাঁক রয়েছে।
বিধানসভার ছবিটা বুধবার অন্য রকমও তো হতে পারত। বিরোধী দলনেতা হঠাৎ ওয়াকআউট নিয়ে আপত্তি না তুললেও পারতেন। অথবা এমনও হতে পারত যে কংগ্রেস ওয়াকআউট করলই না। বামেদের সঙ্গে সমঝোতা থাকলেও, সব ইস্যুতেই যে কক্ষ সমন্বয় হবে, তেমন বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু প্রথমে পায়ে পা মিলিয়ে ওয়াকআউট, তার পর সেই পদক্ষেপকে ভুল হিসেবে আখ্যা দেওয়া, সব শেষে ভুল সংশোধন করে সভাকক্ষে ফিরে যাওয়া— এই রকম একটা ছবি তৈরি করার কোনও দরকার ছিল কি?
অন্য রকম একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনে। জোটপন্থীদের জন্য অস্বস্তিকর এই ছবিটা কি পরিস্থিতির দোষে তৈরি হয়ে গেল? নাকি এই ছবিটা বেশ হিসেব কষেই তৈরি করা হল? বিধানসভার অধিবেশন থেকে এক দিন ওয়াকআউট করে সংসদীয় রাজনীতির খুব ক্ষতি করে ফেলেছিলেন কংগ্রেস বিধায়করা, তেমনটা তো নয়। অধিবেশনে এ দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ বাকি থেকে গিয়েছিল, সে রকম খবরও মেলেনি। তা সত্ত্বেও সদলবলে আলাদা হয়ে পৃথক অস্তিত্ব জানান দেওয়া এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ল কংগ্রেসের জন্য?
বাম-কংগ্রেসের জোট নিয়ে বাংলার শাসক দল যা বার বার বলছে, সেই বক্তব্যই কি খানিকটা প্রতিষ্ঠা পেল না এই ঘটনায়? জোট বা সমঝোতা যে শুধু ভোটের জন্য হয়নি, অন্যতর এবং বৃহত্তর লক্ষ্য যে রয়েছে— তা প্রমাণ করার কোনও দায় কি আর অনুভব করছেন না সিপিএম বা কংগ্রেসের নেতারা? ভোটের আগে দু’পক্ষই তো বলেছিলেন, সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের চাহিদায় এই জোট। বার বার শোনাচ্ছিলেন, মানুষের ইচ্ছায় জোট, নেতৃত্বের ইচ্ছায় নয়। যে মানুষরা আপনাদের সঙ্গে থেকেছেন বা রয়েছেন, তাঁদের ইচ্ছার প্রতি মর্যাদা দেওয়ার তাগিদটা কি এখন আর টের পাওয়া যাচ্ছে না?
বাম-কংগ্রেস সখ্য শেষ হয়ে গিয়েছে— এমনটা বলার সময় এখনও আসেনি ঠিকই। কিন্তু নেতাদের আচরণে প্রতীত হতে চায়— এ সখ্যের সবটা বোধ করি খাঁটি নয়। ভেজাল রয়েছে বুঝি কোথাও।
কারও ক্ষেত্রে নেতৃত্বের চাপ রয়েছে। কারও ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারও ক্ষেত্রে পার্টি লাইনের দায় রয়েছে। সে সবের ঝড়-ঝাপটা থেকে অনুগামীদের রক্ষা করতে দুর্যোগের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোই নেতৃত্বের কাজ। যদি সত্যিই কোনও দিন বিশ্বাস করে থাকেন, বাংলায় সিপিএম এবং কংগ্রেসের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা জোট চেয়েছিলেন, তা হলে বুক দিয়ে আগলে রাখুন তাঁদের আবেগকে। নেতৃত্বের অন্দর মহল হাওয়া-পাল্টা হাওয়ায় হয়তো উত্তাল। কিন্তু তার আঁচ অনুগামীদের উপর পড়তে দেওয়া নেতার ব্যর্থতা।
ধোঁয়াশা নয়, রাজনীতিতে স্বচ্ছতাই কাম্য। সবটাই যদি জোড়াতালি আর গোঁজামিল হয়, তা হলে জটটা এই বেলাই ছাড়িয়ে ফেলা ভাল।