শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের চাপের মুখে প্রথম দফায় প্রবেশিকা পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
সেই চাপেরই দ্বিতীয় দফায় স্নাতকোত্তর স্তরের তিনটি বিষয়ের ভর্তি-পরীক্ষা বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হল সোমবার।
ইদানীং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে সরকারি হস্তক্ষেপের হাজারো অভিযোগ উঠছে। তারই মধ্যে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের চাপের মুখেও দফায় দফায় নতি স্বীকার করে চলেছে কলকাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশ্ন উঠছে, পরীক্ষার মতো বিষয়ে ছাত্র সংগঠনের দাবি বা চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে আদৌ পিছু হটবেন কেন? এ ভাবে নতি স্বীকার করলে স্বাধিকারের স্বাভিমানের মূল্য থাকে কোথায়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কঠোর হাতে শৃঙ্খলারক্ষার দাবিই বা হালে পানি পায় কী ভাবে?
শিক্ষা শিবিরে তো এই সব প্রশ্ন উঠছেই। কর্তৃপক্ষ কেন শাসক দলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর ‘অন্যায় আবদার’ মেনে পরীক্ষা পিছোনো বা পরীক্ষাস্থল সরানোর মতো সিদ্ধান্ত নিলেন, তা নিয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরেও। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, গত সপ্তাহেই ওয়েবসাইটে ওই প্রবেশিকা পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতে জানানো হয়, ১০ অগস্ট, সোমবার বালিগঞ্জ, রাজাবাজার সায়েন্স ও বিহারীলাল কলেজে প্রায় ১৫ হাজার প্রার্থীর প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দখলে থাকা ছাত্র সংসদের তরফে গত সপ্তাহে উপাচার্যের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। তাদের দাবি ছিল, বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষার আসন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে সরিয়ে দিতে হবে। তার পরেই কর্তৃপক্ষের তরফে তড়িঘড়ি ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, সোমবারের প্রবেশিকা পরীক্ষা স্থগিত রাখা হচ্ছে। কিন্তু ছাত্র সংসদের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের সেই নতিস্বীকারের ঘটনায় শিক্ষক শিবির ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রশ্ন ওঠে, কবে কোথায় কোন পরীক্ষা নেওয়া হবে, কর্তৃপক্ষ কি সেটা ছাত্র সংসদের অনুমোদনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করবেন?
বিস্ময় ও ক্ষোভ চূড়ান্তে ওঠে সোমবার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুগত মারজিত এ দিন ছাত্র সংসদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, ভূগোল, সমুদ্রবিজ্ঞান ও প্রাণিবিদ্যার প্রবেশিকা পরীক্ষা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে স্থানান্তরিত করা হবে। তবে পরীক্ষা কবে হবে, এ দিনের বৈঠকে সেই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার মতো বিষয়ে ছাত্র সংসদের চাপের কাছে মাথা নোয়ালেন কেন, সেই প্রশ্ন নিয়ে সারা দিন জল্পনা চলে শিক্ষা শিবিরে।
বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ অবশ্য কোনও চাপ বা আবদারের কাছে নতিস্বীকারের অভিযোগ মানতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য, কোনও দাবি-টাবি নয়। বালিগঞ্জে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হয়ে গিয়েছিল। অথচ রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পরীক্ষা নেওয়ার মতো আসন ফাঁকা পড়ে আছে। সেই জন্যই প্রবেশিকা পরীক্ষা সেখানে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্য শুনে শিক্ষকদের প্রশ্ন, ওয়াবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে সেটা জানানো হল না কেন? সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কেনই বা ছাত্র সংসদের সঙ্গে বৈঠক করতে হল?
কর্তৃপক্ষ এ-সব প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে চাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার বিশৃঙ্খলার মধ্যে জুলাইয়ে অস্থায়ী উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই কড়া বার্তা দিয়েছিলেন সুগতবাবু। তার জেরে শিক্ষকদের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলেন ১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-নিগ্রহের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা সৌরভ অধিকারী।
শক্ত হাতে হাল ধরার আশ্বাস দিয়েও উপাচার্য এখন পরীক্ষার ব্যাপারে সেই সৌরভদের আবদারকেই মান্যতা দিলেন কেন, দিনভর ঘুরপাক খেয়েছে সেই প্রশ্ন।
জবাবের জন্য উপাচার্যের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মোবাইল সাড়া দেয়নি।