সুন্দরবন

দৈনিক গড়ে তিন শিশুর ডুবে মৃত্যু সুন্দরবনে, বলছে সমীক্ষা

বিশ্বের দরবারে পরিচিত জল আর ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ঘেরা সুন্দরবনে জলে ডোবা শিশুকে বাঁচাতে এখনও ডাক পড়ে ওঝার।

Advertisement

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২০ ০৩:২৪
Share:

গত দু’বছরে সুন্দরবন এলাকায় ছ’শোর বেশি শিশু ডুবে মারা গিয়েছে

জলার ধারে জঙ্গলে পড়ে শিশুর দেহ। ভিড় জমেছে সেখানে। আগুন জ্বেলে মন্ত্র পড়ছেন ওঝা। মাঝেমধ্যেই লাঠি দিয়ে জলে বা ঝোপে মেরে বলছেন, “প্রাণ ফিরিয়ে দে।” শেষে গ্রামেরই কয়েক জন জোর করে নিস্তেজ শিশুটিকে নিয়ে যান স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। হৃদ‌্‌যন্ত্র পাম্প করে চিকিৎসক বাঁচান ওই শিশুকে।

Advertisement

বিশ্বের দরবারে পরিচিত জল আর ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ঘেরা সুন্দরবনে জলে ডোবা শিশুকে বাঁচাতে এখনও ডাক পড়ে ওঝার। শিক্ষা আর সচেতনতার আলোর অভাবেই মন্ত্রতন্ত্র আর ঝাড়ফুঁকের মাঝে মৃত্যু হয় শিশুদের।

উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মধ্যে বিস্তৃত সুন্দরবন এলাকার শিশুমৃত্যুর এই দিকটি সম্প্রতি উঠে এসেছে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের নজরে। জলে ডুবে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গত এক বছর ধরে জেলা স্বাস্থ্য দফতর এবং স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলির সঙ্গে সমীক্ষা চালিয়েছিল কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। দেখা গিয়েছে, ওই এলাকায় হুপিং কাশি, ডায়রিয়া বা ম্যালেরিয়ার চেয়েও জলে ডুবে অনেক বেশি শিশু মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যাকে ‘লিডিং কিলার অব চিলড্রেন’ বলে ব্যাখ্যা করছে।

Advertisement

ওই সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, গত দু’বছরে সুন্দরবন এলাকায় ছ’শোর বেশি শিশু ডুবে মারা গিয়েছে। অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রেই ঝাড়ফুঁক মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। রিপোর্ট বলছে, প্রতিদিন অন্তত তিনটি শিশু ডুবে মারা যায়। যাদের গড় বয়স ১-৯ বছর। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষক রাজু বিশ্বাস জানান, গত বছরে গোসাবার শম্ভুনগর পঞ্চায়েত এলাকায় জল থেকে তুলে আড়াই বছরের এক শিশুকে বাঁচাতে ঝাড়ফুঁক করছিলেন এক ওঝা। রাজু ও অন্য কয়েক জন শিশুটিকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে সে বেঁচে যায়।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল অফিসার (৩) ভাস্কর বৈষ্ণব জানান, নদী, সাগর ও খাঁড়ি অধ্যুষিত সুন্দরবনের চার দিকেই জল। জোয়ার-ভাটার কারণে পুকুর বা জলাশয়গুলি সারা বছরই জলে ভরে থাকায় ডুবে শিশু-মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটে। স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে এই সমস্যা দূর করতে কাজ শুরু হবে।

ওই সমীক্ষায় যুক্ত একটি সংস্থার তরফে সুজয় রায় জানান, দেখা গিয়েছে, বেশির ভাগ দুর্ঘটনাগ্রস্ত পরিবারের ঘর জলাশয় সংলগ্ন। বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে ঘটে। অর্থাৎ, যখন মহিলারা বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকেন। তিনি বলেন, “বাড়ি থেকে পাঁচ মিটারের মধ্যেই পুকুর। একাধিক সন্তান থাকায় বাড়ির কাজ সামলে মায়ের পক্ষে প্রত্যেকের দিকে লাগাতার খেয়াল রাখা সম্ভব হয় না।”

গত এপ্রিলে কুলতলির ভুবনেশ্বরী গ্রামে বাড়ির সামনের পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয় ১ বছর ৮ মাসের এক শিশুর। মা স্বপ্না পাল বড় মেয়ের কাছে তাকে রেখে গিয়েছিলেন সরকারি প্রকল্পের গ্যাস নিতে। কাঁদতে কাঁদতে স্বপ্নাদেবী বলেন, “বাড়ি ফিরে শুনলাম, মেয়েকে পুকুর থেকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি।”

দুই ২৪ পরগনার ২০৫টি গ্রাম নিয়ে এই সমীক্ষা হয়েছিল। উত্তর ২৪ পরগনার ছ’টি ব্লক, বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি ১ ও ২, মিনাখাঁ এবং হাড়োয়া। অন্য দিকে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ১৩টি ব্লক, যথা বাসন্তী, ক্যানিং-১ ও ২, গোসাবা, জয়নগর ১ ও ২, কাকদ্বীপ, কুলতলি, মথুরাপুর ১ ও ২, নামখানা, পাথরপ্রতিমা ও সাগরে সমীক্ষা হয়েছিল। রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে ডব্লিউএইচও-র কাছে। ওই সংস্থা মনে করছে, অবিলম্বে ওই সব এলাকায় বাড়ির চৌহদ্দি বা পুকুর বেড়া দিয়ে ঘেরা জরুরি। সংস্থার মতে, একটি বয়সের পরে ছোটদের সাঁতার শেখাতে হবে। যাতে কোনও শিশুকে ডুবতে দেখলে তারাই উদ্ধার করতে পারে।

সরকারি আধিকারিকদের মতে, ঠিক মতো প্রশিক্ষণ পেলে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কিংবা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারাও এ কাজের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement