শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সিএজি রিপোর্টে যে সব অনিয়মের কথা বলা হয়েছে, তার কোনওটাই তৃণমূল জমানায় হয়নি বলে দাবি করলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। শনিবার তিনি বলেন, ‘‘রিপোর্টে যা বেরিয়েছে তার সবই হয়েছে বাম আমলে।’’ এই সংবাদ প্রকাশ করায় আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দেন তিনি।
আর রাজ্য স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর চেয়ারম্যান সৌমিত্র সরকারের বক্তব্য, সিএজি সাম্প্রতিক কোনও শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার অডিটই করেনি। যে সাতটি পরীক্ষার অডিট হয়েছে তা ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে নেওয়া হয়েছিল। ২০১২ সালে দ্বাদশ শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার তথ্য না-মেলায় তার নিরীক্ষা হয়নি। ফলে গত আট বছরে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না।
সিএজির নিরীক্ষায় অবশ্য জমানা ভাগ করে কোনও মতামত দেওয়া হয়নি। ২০০৯ সালে অনলাইনে পরীক্ষা চালুর পরে সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের ১২টি পরীক্ষা হয়েছে। তার মধ্যে ৯টি পরীক্ষার অনলাইনে থাকা তথ্যপঞ্জি নিয়ে সিএজি নিরীক্ষা চালিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি পরীক্ষা বাম জমানায় নেওয়া। বাকি চারটি ২০১২ ও ২০১৩ সালে নেওয়া।
স্কুল সার্ভিস কমিশনের যে সব পরীক্ষায় অডিট হয়েছে। সূত্র: ছ’নম্বর রিপোর্ট, ২০১৮, সিএজি।
সিএজি ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষের অডিট রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০১৭-এর জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে অনলাইন ব্যবস্থার উপর তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর অডিট চালানো হয়েছে। সে বছরই সেপ্টেম্বরে তারা সরকারকে শিক্ষক নিয়োগে গরমিলের কথা জানিয়ে তদন্ত করার সুপারিশ করে। অডিট শেষ হওয়ার পরে এসএসসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যে ‘এগ্জিট কনফারেন্স’ হয়েছিল, সেখানে কমিশন গরমিলের কথা মেনে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বলে সিএজি রিপোর্টে লিখেছে।
শিক্ষা দফতরের দাবি, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে শিক্ষক নিয়োগের কোনও নথি পাওয়া যায়নি। ফলে তার অডিট হয়নি। সিএজি তাদের রিপোর্টে লিখেছে, ভারত সরকারের রেকর্ড রিটেনশন শিডিউল, ২০১২ অনুযায়ী সরকারি নথি ১০ বছর সংরক্ষণ করতে হয়। স্কুল সার্ভিস কমিশনে তা তিন বছর রাখা হত। কিন্তু ২০১২-তে তৃণমূল জমানার প্রথম শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ঠিক আগে বিধি বদলে বলা হয়, পরীক্ষার ফলপ্রকাশের ছ’মাস পরেই নথি নষ্ট করে দেওয়া যাবে। সিএজি ৯টি পরীক্ষারই নথি ও তথ্য চেয়েছিল। কিন্তু ২০১২-র পরীক্ষার ‘ব্যাক আপ ডেটা’ এসএসসি দিতে পারেনি। ২০১২-র পরীক্ষার চূড়ান্ত প্যানেলের যে তালিকা সিএজির হাতে তুলে দেওয়া হয়, তার টেবিলগুলিও এক রকম ছিল না। সিএজি রিপোর্টে লিখেছে, যে ভাবে প্যানেলের ডেটা টেবিল (.সিএসভি ফরম্যাটে) এ-দিক ও-দিক হয়েছে, তাতে ব্যাক আপ থেকে অডিট চালানো সম্ভব নয়। তাই সিএজি ২০১২-এর পরীক্ষার উপর নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ দিতে অপারগ।
তার অর্থ কি সিএজি সাম্প্রতিক পরীক্ষাগুলির অডিট করেনি? এক সিএজি কর্তা বলেন, ‘‘২০১৭-র জুলাই পর্যন্ত সমস্ত পরীক্ষার অডিট করা হয়েছে। যে সব পরীক্ষা সংক্রান্ত নথি মিলেছে, সে সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যে পরীক্ষার নথি মেলেনি তার পর্যবেক্ষণ দেওয়া যাবে না, সে কথা অডিট রিপোর্টে লিখে দেওয়া হয়েছে।’’ ওই কর্তা জানান, চূড়ান্ত রিপোর্টে ‘অডিট প্যারা’ হওয়ার অর্থই হল, সিএজি তার উপর নিরীক্ষা চালিয়েছে। ২০১১-র আগের পরীক্ষার সমস্ত নথি মিলেছে। কিন্তু ২০১২-র পরে যে পরীক্ষা হয়েছে, তার নথি ছ’মাস পরে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ফলে যেটুকু গরমিল পাওয়া গিয়েছে তা সামগ্রিক ভাবে লেখা হয়েছে। নির্দিষ্ট করে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, যদি বাম আমলেই সব দুর্নীতি হয়ে থাকে, তা হলে বর্তমান সরকার কেন তদন্তের নির্দেশ দিল না? এ কথা বলার পাশাপাশি সিপিএমের পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর পাল্টা দাবি, ‘‘বাম আমলে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় কোনও অনিয়ম হয়নি। যদি হত, তা হলে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হত। যেমনটা এখন তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে হচ্ছে।’’
বাম আমলের শেষ দিকে যিনি এসএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন, সেই রণজিৎ বসুরও দাবি, ‘‘আমার সময় এক বিন্দুও কারচুপি হয়নি। ২০১১ সালে নিয়োগপত্র দেওয়ার পরে কিছু ভুল ধরা পড়ে। তখন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে কোনও মামলাও হয়নি।’’
সিএজির রিপোর্টে অবশ্য বাম জমানায় প্রায় ৫ কোটি টাকা নয়ছয়ের কথা বলা হয়েছে। তার তদন্ত কেন হয়নি? সৌমিত্রবাবু বলেন, ‘‘আমি ১০ জানুয়ারি এসএসসি চেয়ারম্যান পদে যোগ দিয়েছি। এ সব নিয়ে কিছুই জানি না। তবে প্রয়োজন হলে তদন্ত হবে।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।