জীবনযুদ্ধে হারতে নারাজ তিন কন্যাকে কুর্নিশ

বাণীবন গার্লস হাইস্কুলের পড়ুয়া স্বাগতা অধিকারী মারণ রোগ ক্যানসারে আক্রান্ত। চার-চার বার কেমোথেরাপি নিয়েছে সে। চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে বাবা বিক্রি করেছেন দোকান। তবুও হার মানেনি এই কিশোরী। মাধ্যমিকে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে সে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৮ ০৩:৪৮
Share:

ত্রয়ী: মঞ্চে স্বাগতা অধিকারী, পৌলোমী হালদার ও মৌ দেবনাথ (বাঁ দিক থেকে)। শনিবার সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

উত্তর ২৪ পরগনার গোপালপুরের বাসিন্দা পৌলোমী হালদার। তৃতীয় শ্রেণির এই পড়ুয়া চলতি বছরের এপ্রিলে প্রতিবেশীর বাড়িতে ফুল তুলতে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছিল ‘বল’। তা নিয়ে খেলতে গিয়েই ফেটে গিয়েছিল ‘বল’-এ ছদ্মবেশে থাকা বোমা। বাদ যায় হাতের একাংশ। পরে অনেকের সাহায্যে কৃত্রিম হাত পেয়েছে সে। এমন দুর্ঘটনার পরেও দমেনি এই একরত্তি মেয়েটি।

Advertisement

বাণীবন গার্লস হাইস্কুলের পড়ুয়া স্বাগতা অধিকারী মারণ রোগ ক্যানসারে আক্রান্ত। চার-চার বার কেমোথেরাপি নিয়েছে সে। চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে বাবা বিক্রি করেছেন দোকান। তবুও হার মানেনি এই কিশোরী। মাধ্যমিকে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে সে।

আনন্দ আশ্রম বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী মৌ দেবনাথ চোখের সামনে পুড়ে যেতে দেখেছে বাবা-মাকে। আগুনে ঝলসে গিয়েছিল সে-ও। শোকে, কষ্টে ‘পুড়ে’ খাক হয়ে গেলেও হাল ছাড়েনি মৌ। এক দিনের জন্য কামাই করে না স্কুল।

Advertisement

রাজ্যের এমন তিন কন্যাকে শনিবার সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে কুর্নিশ জানাল ‘দ্য টেলিগ্রাফ’। এ দিনের ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস’ অনুষ্ঠানে মনোবলকে সম্মান জানিয়ে তিন জনের হাতে ‘দ্য সোনিকা চৌহান ২৭ ফাউন্ডেশন স্কলারশিপ’ তুলে দিলেন পথ দুর্ঘটনায় মৃত মডেল সোনিকা চৌহানের বাবা-মা।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় হারিয়ে যুদ্ধে জয়ীদেরও কুর্নিশ জানানো হয়েছে এ দিন। ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সৌরভকুমার সিংহের জন্ম থেকেই হাত আর পায়ের বেশির ভাগ অংশ নেই। কিন্তু পায়ের আঙুলের ফাঁকে পেন ধরে অনায়াসে লিখতে পারে সে। ইন্ডাস ভ্যালি ওয়ার্ল্ড স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী দেবস্মিতা ঘোষ স্নায়ুর জটিল রোগ ‘স্পাইনাল মাসকিউলার অ্যাট্রফি’-তে আক্রান্ত। কিন্তু রোগ তাকে কাবু করতে পারেনি। জাতীয় অলিম্পিয়াডে স্থানাধিকারী এবং রাজ্যের ‘অ্যারিথমেটিক জিনিয়াস কনটেস্ট’-এ ফাইনালিস্ট হয়েছে সে। যেমন হুইল চেয়ারে বসেই অঙ্কুর দাস রাজ্যের প্রথম প্যারা রাইফেল শ্যুটার হয়েছেন। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও পরীক্ষার ফলে তাক লাগিয়েছেন ইপ্সিতা গুপ্ত।

কেউ কেউ আবার উতরে গিয়েছেন জীবনের কঠিন সময়ের পরীক্ষায়। ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অনিতা সাহার মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পড়ার ফাঁকেই ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের জন্য ছুটে বেড়াত অনিতা। বাবা বাঁচেননি, কিন্তু এই মেয়েকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। আর্থিক অনটনকে তোয়াক্কা না করেই ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছেন মৌসুমি খাতুন। স্বপ্ন, যে কঠিন রোগ বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, তার সঙ্গে পাঞ্জা কষে রোগীদের বাঁচাবেন তিনি। পিছিয়ে প়়ড়া জনজাতি কিংবা মূলস্রোতের বাইরে থাকা সোনাগাছিতে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর উদ্যোগকেও সম্মান জানানো হয়েছে।

আদর্শ শিক্ষক হিসেবে সম্মানীত হয়েছেন বসিরহাটের ‘মাস্টারমশাই’ সুভাষচন্দ্র কুণ্ডু। নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে পুরুলিয়ায় শবর জনজাতির শিশুদের জন্য স্কুল গড়ে তুলেছেন কলকাতা পুলিশের সাউথ ট্র্যাফিক গার্ডের কনস্টেবল অরূপ চক্রবর্তী। নিজের বাড়িতে শিশুদের রেখে পড়াশোনা করানোর জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন প্রাক্তন বনকর্মী প্রফুল্ল নায়েক। এবং এই অনুষ্ঠানেই দেখা গেল এ যুগের এক ‘সব্যসাচী’-কে। ইতিহাসের শিক্ষক তপন দে শুধু পড়ান না, তিনি চার হাত-পায়ে চারটি ভাষায় একাধিক বিষয়ে অনর্গল লিখে যেতে পারেন।

তপন, অরূপ, প্রফুল্লবাবুরা এ দিন পুরস্কারও তুলে দিলেন কৃতীদের হাতে। আর নিঃশব্দে বলে গেলেন, ‘চরৈবেতি!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement