মিলন সর্দার। —ফাইল চিত্র।
বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোয় গ্রেফতার হয়েছেন তৃণমূলের বেশ কয়েক জন নেতা-মন্ত্রী। কিন্তু কাউকে অপহরণ করে তা থেকে পাওয়া মুক্তিপণের টাকায় ফুলেফেঁপে ওঠার ঘটনা বোধহয় এ-ই প্রথম। যা দেখা গেল বারাসত পুরসভার পুরপ্রতিনিধি মিলন সর্দারের ক্ষেত্রে। যে অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতিতে রূপান্তরের মতোই সোনার কারিগর থেকে কোটিপতি হয়ে উঠেছিলেন মিলন। অপহরণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরে দল থেকে বহিষ্কার করে তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছে তৃণমূল। যদিও প্রশ্ন উঠেছে, দু’দফায় ভোটে দলীয় টিকিট পাওয়া ওই পুরপ্রতিনিধির এই আকস্মিক ‘উত্থান’ কী করে চোখ এড়িয়ে গেল নেতৃত্বের?
বারাসতের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি হিসাবে প্রথম বার পুরসভায় যোগ দিয়েছিলেন মিলন। গ্রেফতার হওয়ার আগে ছিলেন দু’নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি। ত্রিপুরার এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে সিআইডি মিলনকে বৃহস্পতিবার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের ন’পাড়ার গোপাল স্মৃতি সঙ্ঘ এলাকায় তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। শুক্রবার ব্যারাকপুর আদালতে তোলা হলে বিচারক মিলনকে ন’দিনের জন্য সিআইডি-র হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
সিআইডি জানিয়েছে, দেবব্রত দে নামে ওই ব্যবসায়ীকে গত বছর দু’বার অপহরণ করে প্রায় সওয়া ন’কোটি টাকা আদায় করেন মিলন। তবে, দেবব্রত কেন পুলিশের কাছে যাননি, তা নিয়ে থেকে গিয়েছেধোঁয়াশা। মিলন ও দেবব্রতকে মুখোমুখি বসিয়ে এই রহস্যের কিনারা করতে চায় সিআইডি। তদন্তে জানা গিয়েছে, এ বার ত্রিপুরার অন্য এক ব্যবসায়ীর পরিকল্পনায় দেবব্রতকে ফের অপহরণ করা হয়। নিজের দু’নম্বর ওয়ার্ডের দলীয় কার্যালয়ে বসেই মিলন সেই ঘটনার ছককষেছিলেন। অভিযোগ, তাঁর নির্দেশেই দু’কোটি ২৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয় ওই ব্যবসায়ীর পরিবারের কাছ থেকে।
সিআইডি সূত্রের খবর, অগস্টের শেষে সোদপুরের একটি আবাসনে তাঁর এক পরিচিতের বাড়িতে আসেন দেবব্রত। ওই আবাসনে ঘর ভাড়া নিয়েছিল অভিযুক্তেরাও। অভিযোগ, সেপ্টেম্বরের শুরুতে আবাসনের পার্কিং লটে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে দেবব্রতকে অপহরণ করে বারাসতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি ফ্ল্যাটে আটকে রাখা হয় তাঁকে। দেবব্রতের এক বন্ধু সিআইডি-কে বিষয়টি জানালে গোয়েন্দারা তাঁকে উদ্ধার করেন। তদন্তকারীরা জানান, মিলন ছাড়াও এই ষড়যন্ত্রে ত্রিপুরার এক ব্যবসায়ী-সহ অনেকে রয়েছে। এই ঘটনায় সাত জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা জানতে পারেন মিলনের কথা।
৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের লোকজন জানান, গয়নার কারিগর ছিলেন মিলন। ২০১৫ সালে ওই ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পরেই কারিগরের চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। কিছু দিন পর থেকেইমিলনের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। নিজের ওয়ার্ডে সরকারি বাড়ি দেওয়ার জন্য শতাধিক গরিব মানুষের কাছ থেকে মাথাপিছু আট হাজার টাকা করে নেওয়ার অভিযোগে বাসিন্দারা মিলনের উপরে চড়াও হন। তখন মিলন গা-ঢাকা দেন।বর্তমানে তিনি একাধিক বাড়ি ও জমির মালিক বলেই খবর পেয়েছে সিআইডি।
সূত্রের খবর, সোনার গয়নার পুরনো কারিগর মিলন সোনা ঘুষ দিয়েই স্থানীয় নেতৃত্বের কারও কারও ‘মন জয়’ করেন। ওই সূত্রের দাবি, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরেও ২০২২ সালে দু’নম্বর ওয়ার্ড থেকে টিকিট পান মিলন। বারাসত পুরসভার চেয়ারম্যান অশনি মুখোপাধ্যায়ের মতে, টিকিট বণ্টনের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যদিও বারাসতের বিজেপি নেতা তাপস মিত্রের দাবি, ‘‘মুক্তিপণের টাকায় সম্পত্তি বাড়ানোর পাশাপাশি দলের নেতাদেরও ভাগ দিয়েছেন মিলন। তাঁর সঙ্গে পুর চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।’’
যদিও অশনির দাবি, ‘‘মিলন আমার সহকর্মী। এর বাইরে কোনও সম্পর্ক নেই। ব্যক্তিগত ভাবে কে, কোথায়, কী করছে, তা জানা আমার কাজ নয়।’’