এত দিন অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে গলা মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গও দাবি তুলত, কেন্দ্রীয় প্রকল্প ভিত্তিক অর্থ নয়। যা টাকা দেওয়ার, তা এমনিই দিয়ে দেওয়া হোক। রাজ্য নিজের খুশি মতো সেই টাকা খরচ করবে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প তুলে দেওয়ার পক্ষেও সওয়াল করত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
এ বার নরেন্দ্র মোদীর সরকার যখন ঠিক সেই কাজটাই করেছে, তখন সুর পাল্টে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে টাকা কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলছে তৃণমূল। এই ‘দ্বিচারিতা’ নিয়েই আপাতত সরগরম দিল্লির রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহল। অর্থ মন্ত্রক থেকে শুরু করে নীতি আয়োগ, সর্বত্রই কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সব মিলিয়ে তো গত আর্থিক বছরের থেকে অনেক বেশি টাকা পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে রাজ্যকে কেন্দ্রীয় করের অংশ বাবদ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বেশি দিচ্ছে মোদী সরকার। অর্থ কমিশনের অনুদান বাবদ বাড়তি মিলবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ৮টি কেন্দ্রীয় প্রকল্প বন্ধ করে এবং কিছু প্রকল্পে কাটছাঁট করে মোট বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাত্ সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাড়তি পাওনার পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির হিসেব অনুযায়ী, ‘‘ইউপিএ-সরকারের শেষ বছরের তুলনায় এ বছর পশ্চিমবঙ্গের বাড়তি পাওনা প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।’’ কোনও বিশেষ প্রকল্পভিত্তিক নয়, রাজ্য নিজের খুশি মতো এই টাকা খরচ করতে পারে। তা হলে মমতা সরকারের অসন্তোষ কীসের, প্রশ্ন তুলছেন দিল্লির অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। তাঁদের একাংশের বক্তব্য, সেই ইউপিএ আমল থেকে রাজ্যের ঋণের বোঝা মকুব করার জন্য কেন্দ্রের কাছে দরবার করে আসছে মমতা সরকার। আগের জমানায় অনুন্নত এলাকা উন্নয়ন তহবিলের মতো কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা দেওয়া হয়েছিল রাজ্যকে। তখন অমিত মিত্ররা বলেছিলেন, এই টাকা প্রকল্পভিত্তিক. এ দিয়ে ঋণ শোধ করা যাবে না। কিন্তু এখন যে বাড়তি টাকা কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, তা থেকে ঋণ শোধ করতে তো কোনও অসুবিধা নেই। অর্থ মন্ত্রকের ওই আধিকারিকদের বক্তব্য, বাড়তি টাকায় রাজ্য দেনার বোঝা কমাবে, না উন্নয়ন করবে, না মেলা-উত্সব-দান-খয়রাতি করবে, তা সরকারের অগ্রাধিকারের উপরেই নির্ভর করছে।
কেন্দ্রীয় প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, এই সামাজিক প্রকল্পগুলির দায় একা কেন্দ্রের নয় এবং সেগুলি রাজ্যের ‘জন্মগত অধিকার’-এর মধ্যেও পড়ে না। কোনও রাজ্য যদি মনে করে যে কোনও প্রকল্প তাদের প্রয়োজন, তা হলে সেই প্রকল্পের আর্থিক দায়ও তাকে বহন করতে হবে। তা না করে রাজ্যগুলি শুধু ভোটের রাজনীতির টানে জনমোহিনী প্রকল্পে টাকা ঢেলে যাবে, এটা চলতে পারে না। অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, যোজনা কমিশন পরবর্তী যুগে এই ধরনের প্রকল্পে কেন্দ্রের ভূমিকা ক্রমশ কমে আসবে। মোদী-জেটলি সংস্কার পর্বে কেন্দ্র হাতে গোনা কয়েকটি সামাজিক প্রকল্প চালাবে এবং তার আর্থিক দায়ভার পুরোপুরি কেন্দ্রই বহন করবে। এই সংস্কারের সঙ্গে বহু অর্থনীতিিবদ যেমন একমত, তেমনই একমত একাধিক রাজ্যও। তাদের মতে, এক এক রাজ্যের প্রয়োজন এক এক রকম। দিল্লিতে বসে সব রাজ্যের জন্য এক রকম প্রকল্প গড়া তাই কোনও কাজের কথা নয়। রাজ্যগুলির এই দাবিকে সামনে রেখেই সংস্কারের পথে পা বাড়িয়েছেন জেটলি।
এত দিন মোট ৬৩টি কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু ছিল। চলতি বছরের বাজেটে জেটলি ঘোষণা করেছেন, এর মধ্যে ৮টি প্রকল্পে আর কোনও কেন্দ্রীয় সাহায্য দেওয়া হবে না। ২৪টি প্রকল্পে কেন্দ্র ও রাজ্যের দেয় টাকার অনুপাত বদলাবে। তবে একশো দিনের কাজ, সংখ্যালঘু উন্নয়নে বহুমুখী প্রকল্পের মতো ৩১টি দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের পুরো খরচ কেন্দ্র বহন করবে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সংখ্যা আরও কমানো যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে নীতি আয়োগে মুখ্যমন্ত্রীদের একটি কমিটিও তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রের আর্থিক অনুদান কমানো নিয়ে রাজ্য বিধানসভায় গৃহীত প্রস্তাব খণ্ডন করে গত কাল অরুণ জেটলি যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার পরে এখনও মুখ খোলেননি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। তবে তৃণমূলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অনুদান কমানোর বিষয়টিই ফের তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের অর্থ দফতরের কর্তারাই বলছেন, সব মিলিয়ে যে রাজ্যের হাতে বাড়তি টাকা আসছে, সেই সত্যটা চেপে যাচ্ছে রাজ্যের শাসক দল। এই টাকায় ঋণ শোধ বা পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হবে, এমন ইঙ্গিতও তাদের তরফে নেই। বিধানসভা ভোটের আগের বছরে এই বাড়তি টাকা ভাতা-অনুদান, দান-খয়রাতেই খরচ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা অর্থ দফতরের অনেক কর্তার।
সে ক্ষেত্রে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে, তা ভেবে শিউরে উঠছেন তাঁরা। অমিতবাবু নিজেই এ বছরের বাজেটে বলছেন, চলতি বছরে রাজ্যের ঋণের বোঝা ২ লক্ষ ৯৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থ দফতর সূত্রের বক্তব্য, দু’বছর পরে পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন হবে। বাম জমানায় ৫ থেকে ১৫ বছরের মেয়াদে যে সব ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তখন সেগুলি শোধ করার সময় আসবে। রাজ্যে শিল্প-বাণিজ্য বাড়ার যে হেতু কোনও লক্ষণ নেই, তাই রাজ্যের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির সুযোগও কম। সে ক্ষেত্রে রাজ্যের নিজস্ব আয়ের গোটাটাই ঋণ শোধে চলে যাবে। কেন্দ্রের কাছ থেকে বাড়তি টাকা পেয়েও আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে রাজ্যের অর্থনীতি।