মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত রেল ও এনটিপিসি-র তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। প্রস্তাবিত মোহনপুরা জঙ্গল সাফ হয়ে যাচ্ছে।—নিজস্ব চিত্র।
রেল-এনটিপিসি যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুত্কেন্দ্রকে ঘিরে এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আদ্রাবাসী, সেই স্বপ্নের রঙ ক্রমশ ফিকে হচ্ছে।
ওই প্রকল্পের কথা ঘোষণার পর কয়েক বছর কেটে গেলেও বিদ্যুত্কেন্দ্র নির্মাণে একটি ইঁটও গাঁথা হয়নি। পরিবর্তে সাফ হয়ে যাচ্ছে প্রস্তাবিত বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জন্য চিহ্নিত জমির বনাঞ্চল। চুম্বকে এটাই আদ্রায় রেল ও এনটিপিসির যৌথ উদ্যোগে প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রের বাস্তব ছবি। শিল্পাঞ্চলের তকমা পাওয়ার যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন রেল শহর-সহ লাগোয়া তিনটি পঞ্চায়েতের বাসিন্দারা, সেই আশা আজ কার্যত মরীচিকা। শিল্প গড়ে ওঠেনি।
১১ বছর আগে আদ্রা ডিভিশন থেকে রাঁচিকে আলাদা করে পৃথক ডিভিশন গড়ার পর থেকেই কৌলিন্য হারিয়েছে আদ্রা। কমেছে এই ডিভিশনের গুরুত্বও, কমেছে লোকজনের রুজি রোজগার। এই পরিস্থিতিতেই ২০১০ সালে তত্কালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ঘোষণা করেছিলেন, আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আদ্রায় ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত্কেন্দ্র তৈরি করা হবে, তখন তা স্বাগত জানিয়েছিলেন তামাম আদ্রাবাসী। বিদ্যুত্কেন্দ্রের হাত ধরে এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু এখনও তার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
অথচ সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। লোকসভায় রেল বাজেটে শুধু ঘোষণাই নয়, আদ্রা ডিভিশনে এসে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে এনটিপিসি-র সাথে এই বিদ্যুত্কেন্দ্র গঠনে মৌ-চুক্তি সম্পন্ন পর্যন্ত করে গিয়েছিলেন মমতা। স্থির হয়েছিল আদ্রার উপকন্ঠে রেলের হাতে থাকা মোহনপুরা জঙ্গলে ১০৬২ একর জমিতে হবে ওই বিদ্যুত্কেন্দ্র। প্রকল্পে জলের সংস্থান করতে সম্মত হয়েছিল ডিভিসি। এমনকী বিদ্যুত্ কেন্দ্র গঠনে পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র পেতে আদ্রায় জনশুনানি পর্যন্ত হয়েছিল। রেল, এনটিপিসি, জেলা প্রশাসন ও রাজ্য পরিবেশ দফতরের কর্তাদের উপস্থিতিতে ওই শুনানিতে প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছিলেন সকলেই। প্রকল্প ঘিরে এলাকায় কী পরিমাণে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল শুনানিতেই।
তাহলে কেন প্রকল্প নির্মাণের কাজ শুরু হল না? প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে আদ্রাবাসী। আর এই প্রেক্ষিতেই এসে পড়ছে জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ। খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের নীতিকে ঘিরে কংগ্রেসের সাথে মনোমালিন্যের জেরে কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে তৃণমূল সরে আসার পরেই এই বিদ্যুত্কেন্দ্র গড়ার প্রক্রিয়াতে ভাটা পড়ে। রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব যায় কংগ্রেসের হাতে। অভিযোগ, পরপর দু’টি রেল বাজেটে আদ্রার এই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করেনি রেলমন্ত্রক। আর কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরে বিজেপি-র তত্কালীন রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া রেল বাজেটে ঘোষণাই করেছিলেন যে প্রকল্প রেলের কাছে বাস্তবসম্মত নয়, সেই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করবে না রেলমন্ত্রক।
বস্তুত আদ্রার এই বিদ্যুত্কেন্দ্র প্রকল্প কার্যত যে হিমঘরে চলে যাচ্ছে, ঘটনাপ্রবাহে তা অনেকটাই স্পষ্ট এলাকাবাসীর কাছে। এনটিপিসি-র সাথে মৌ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পরে এই প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এনটিপিসি-র এক অতিরিক্ত জেনারেল ম্যানজার পদের আধিকারিককে। আদ্রায় রেলের দু’টি আবাসন এনটিপিসির জন্য বরাদ্দ করেছিল রেল। একবার শুধু জমি পরিদর্শনে এসেছিলেন এনটিপিসির কর্তারা। বর্তমানে সেই আবাসন দু’টিও ফিরিয়ে নিয়েছে রেল। মাঝখানে নির্বিচারে গাছ সাফ হয়ে যাচ্ছে মোহনপুরা জঙ্গলে।
তবু রেল শহর আদ্রা-সহ পাশের আড়রা, কালিকেন্দ, মোহনপুরা, গগনাবাইদ গ্রামের বাসিন্দারা আশা পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি। তাঁদের আশা, একদিন সত্যিই ওই বিদ্যুত্কেন্দ্র তৈরি হবে। তাঁদের মধ্যে মধু বাউরি, গগন মাহাতো, কিঙ্কর বাউরিদের কথায়, “রুখা জমিতে চাষ হয় না। দিনমজুরের কাজই ভরসা। অথচ প্রতিদিন সেই কাজও মেলে না। বড় আশা ছিল বিদ্যুত্কেন্দ্র হলে কাজের সুযোগ মিলবে। এখনও কিছুই হল না। তবে আশা ছাড়িনি। হয়তো সত্যিই একদিন কাজ শুরু হবে।”
ওই বিদ্যুত্কেন্দ্র না হওয়ার জন্য তৃণমূলকেই দায়ী করছেন বিরোধীরা। সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার অভিযোগ, “শুধুমাত্র রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই ফায়দা তোলার জন্য রেলমন্ত্রী হিসাবে এই ধরনের প্রকল্পগুলির ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।” নীতিশ কুমার রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে বিহারের নবীনগরে আদ্রার ধাঁচেই এনটিপিসিকে সাথে নিয়ে বিদ্যুত্কেন্দ্র গড়েছেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে বাসুদেববাবুর বক্তব্য, “আদ্রায় বিদ্যুত্কেন্দ্র গড়তে জমি অধিগ্রহনের দরকার ছিল না। প্রয়োজনীয় জমি রেলের হাতেই ছিল। আর তিন বছর রেলের দায়িত্বে থেকে তৃণমূল তা করতে পারল না। আসলে প্রকল্প রূপায়ণে কখনই আন্তরিকতা ছিল না তৃণমূলে।”
ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের পুরুলিয়ার সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতোর দাবি, “রেলমন্ত্রী হিসাবে এই প্রকল্প ঘোষণা করাই শুধু নয়, প্রকল্প রূপায়নের কাজ অনেকটাই এগিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে প্রথমে কংগ্রেস পরে বিজেপি এই প্রকল্প রূপায়ণে আগ্রহী নয়।” লোকসভায় শীতকালীন অধিবশনে আদ্রার বিদ্যুত্কেন্দ্র নিয়ে সরব হবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত করা কেন্দ্রের নৈতিক দায়িত্ব।”
স্থির হয়েছিল ২০১৫ সালে বিদ্যুত্কেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন হবে। যেখানে শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার কথা ছিল, ২০১৪ সালের শেষেও সেই জমি ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। তাপবিদ্যুত্ প্রকল্পের সঙ্গে জমির ছবিটা যেন প্রতীকী।