আলোর উপরে অঝোর ধারে বৃষ্টি। ছবি: অনির্বাণ সেন
মঞ্চে অনুষ্ঠান করছেন সিকিমের লোকশিল্পীরা। বাইরে থেকে নাগাড়ে বৃষ্টির শব্দ কানে আসছে। দর্শকাসন থেকে উঠে মঞ্চের দায়িত্বে থাকা আলোকশিল্পীর কাছে গিয়ে বললেন, “ছাদ ফুটো থাকায় আলোর উপর বৃষ্টি পড়ছে। সাবধান, যে কোনও সময় লাইট ফেটে যেতে পারে!” আলোকশিল্পী সতর্ক হলেও দেখা গেল মঞ্চে যেখানে শিল্পীরা তাঁদের আনুষঙ্গিক যন্ত্র নিয়ে বসেছেন, জল পড়ছে সেখানেও। একটু পরে ফুটো ছাদ দিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু হল মঞ্চের বিভিন্ন অংশে!
সম্প্রতি একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এমন বেহাল এই চিত্রই দেখা গেল রামপুরহাট শহরের ‘রক্তকরবী পুরমঞ্চে’। এক সময় টাউন হল ছিল এই শহরের সংস্কৃতি চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এগারো বছর আগে জরাজীর্ণ সেই টাউন হলের সংস্কারের কাজ শুরু হয়। দফায় দফায় টাকা বরাদ্দ হলেও কাজ হয়েছে শম্বুক গতিতে। অভিযোগ, শেষমেষ ২০০৯ সালে অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই ‘রক্তকরবী মঞ্চ’ নাম দিয়ে টাউন হলের উদ্বোধন করে দেওয়া হয়। অথচ সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবি, নাটক তো দূরের কথা, ছোটখাটো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার মতোও পরিকাঠামো নেই এই পুরমঞ্চের। বর্ষায় সেই আগের মতোই ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে। জেনারেটর আছে, কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির অভাবে একটানা চালু রাখা যায় না। নেই পানীয় জলের সংযোগ, অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থা। কোনও শীতাতপ যন্ত্র নেই, গরমে দর্শকদের গলদঘর্ম অবস্থা হয়। অথচ নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য হল ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। আর ওই সব অনুষ্ঠান চলাকালীনই উপরের বর্ণনার মতোই বারবার প্রকাশ হয়ে পড়ছে ‘রক্তকরবী মঞ্চ’-এর দৈন্য দশা।
প্রশাসন সূত্রের খবর, দীর্ঘ দিন ধরে এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবি মেনে জেলা প্রশাসন হলের সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। ২০০৩-০৪ আর্থিক বর্ষে বীরভূম কেন্দ্রের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোমের সাংসদ তহবিলের টাকায় টাউন হল সংস্কারের কাজ শুরুও হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় সাংসদ মোট ১ কোটি ৭০ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। মাঝে সাংসদ তহবিল থেকে ৫ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা দেন রাজ্যসভার প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক সাংসদ দেবব্রত বিশ্বাসও। সংস্কারের দায়িত্ব পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম (ডব্লিউবিআইআইডিসি)। ওই সরকারি সংস্থা কাজের বরাত দেয় একটি বেসরকারি ঠিকা সংস্থাকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, লোকসভা ভোটের মুখে ২০০৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই নতুন নামে টাউন হলের উদ্বোধন করে দেওয়া হয়।
মহকুমার সাংস্কৃতিক কর্মীরা শহরের একমাত্র সরকারি সাংস্কৃতিক মঞ্চের বেহাল দশায় ক্ষুব্ধ। নাট্যকর্মীদের অভিযোগ, সঠিক ভাবে নাটক পরিবেশনের জন্য ওই মঞ্চে উপযুক্ত কোনও পরিকাঠামোই নেই। শহরের নাট্যকর্মী প্রিয়ব্রত প্রামাণিক বলেন, “মঞ্চে কাঠের পাটাতন অসমতল। গ্রিন রুমে প্রয়োজনীয় আসবাবই নেই। দর্শকাসনে ‘ফুট ল্যাম্পে’র যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা কাজ করে না। হলের আলো ও শব্দ প্রক্ষেপণ ব্যবস্থাও ভালো নয়।” কার্যত একই অভিযোগ শহরের সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সংগঠন ‘সম্মিলনী’র সভাপতি মিহির রায়েরও। তিনি বলেন, “হলের ভিতরে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কাজ ভাল না হওয়ার জন্য বাইরে বৃষ্টি হলে হলের ভিতরে তার আওয়াজ ঢোকে। এত বড় হলে কোনও অগ্নিনির্বাপক বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও নেই! দর্শকদের বসার আসনের মানও বেশ খারাপ।” বাসিন্দাদের আরও দাবি, নব কলবরে এই মঞ্চ তৈরির উদ্দেশ্যই ছিল শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো। কিন্তু বর্তমানে একাধিক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক সংস্থাকে বঞ্চিত করে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কনফারেন্স থেকে রাজনৈতিক সভা-সম্মেলন, এ সবের জন্যই পুরমঞ্চ ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। হলের বর্তমান পরিকাঠামো অনুযায়ী ভাড়াও অনেক বেশি। আর এক বাসিন্দা শুভাশিস চৌধুরীর মন্তব্য, “রক্তকরবী নিয়ে বর্তমান সাংসদ এবং বিধায়ক কার্যত উদাসীন। হলের বর্তমান অবস্থার জন্য প্রশাসনও তার দায় এড়াতে পারে না।”
রক্তকরবী ‘পুরমঞ্চ’ হলেও এখনও তার দায়িত্বভার পুরসভা পায়নি। মহকুমা প্রশাসনই রক্তকরবী পুরমঞ্চের দায়িত্বে রয়েছে। সেখানেই ভাড়ার জন্য আবেদন করতে হয়। তৃণমূল পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারির দাবি, “পুরমঞ্চ লেখা হচ্ছে, অথচ আমাদের কোনও অধিকার এখনও দেওয়া হয়নি। এর আগে অনেকবার বিষয়টি মহকুমাশাসককে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ করেনি। আমরা এ নিয়ে ফের আবেদন করব।” সমস্যার কথা শুনে অবশ্য স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বাস দিয়েছেন, হলটির দ্রুত সংস্কারের ব্যাপারে মহকুমাশাসক, জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলবেন।
যোগাযোগ করা হলে মহকুমাশাসক উমাশংকর এস বলেন, “আমি নতুন এসেছি। হলের ভিতরের সমস্যা খতিয়ে দেখব। ইতিমধ্যেই এ ছাড়াও ভাড়া বাবদ কত টাকা সংগ্রহ হয়েছে, সেই টাকা কোন খাতে খরচ হয়, সে ব্যাপারেও খোঁজ শুরু করেছি। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলাশাসকের সঙ্গে কথাও বলেছি।” যে পরিমাণ টাকা রয়েছে, তা দিয়েই দ্রুত সংস্কারের কাজ শুরু করার আশ্বাসও তিনি দিয়েছেন। অন্য দিকে, জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি। এত দিনেও কেন ওই পুরমঞ্চ পুরসভার হাতে হস্তান্তরিত হয়নি, তা-ও দেখব।” হলের সংস্কারের কাজ দ্রুত শুরু করার ব্যাপারেও তিনি পদক্ষেপ করবেন বলে জানিয়েছেন।