বলবি না তুই বেঁচে, দক্ষিণপদকে বলেন বাবা

যে ছোট্ট ছেলেটাকে অপহরণ করে খুনের অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে কাটিয়েছেন পরাণ বাউরি, সতীশ বাউরিরা, ১৪ বছর পরে তাঁরা জানলেন, সেই ছেলে আসলে বেঁচে আছে! এখন সে তরতাজা এক যুবক। বাঁকুড়ার ছাতনা থানার প্রত্যন্ত গ্রাম মঙ্গলদার পঞ্চাশ শতকের একটা ধানিজমি। তাতে চাষের অধিকার নিয়ে পরাণবাবুদের সঙ্গে বিবাদ ছিল পাশের গ্রাম ছোলাগড়ার গুণরাম মণ্ডলের। রোজ অশান্তি আর ভাল লাগত না গুণরামের ন’বছরের ছেলে দক্ষিণপদর।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছাতনা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৪ ০২:১২
Share:

দক্ষিণপদ মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র

যে ছোট্ট ছেলেটাকে অপহরণ করে খুনের অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে কাটিয়েছেন পরাণ বাউরি, সতীশ বাউরিরা, ১৪ বছর পরে তাঁরা জানলেন, সেই ছেলে আসলে বেঁচে আছে! এখন সে তরতাজা এক যুবক।

Advertisement

বাঁকুড়ার ছাতনা থানার প্রত্যন্ত গ্রাম মঙ্গলদার পঞ্চাশ শতকের একটা ধানিজমি। তাতে চাষের অধিকার নিয়ে পরাণবাবুদের সঙ্গে বিবাদ ছিল পাশের গ্রাম ছোলাগড়ার গুণরাম মণ্ডলের। রোজ অশান্তি আর ভাল লাগত না গুণরামের ন’বছরের ছেলে দক্ষিণপদর। এক দিন ঘর ছাড়ল সে। সেটা ২০০০ সাল। কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে যায় রৌরকেল্লায়। গুণরামের সন্দেহ এসে পড়ে পরাণবাবুর পরিবারের উপরে। তাঁদের বিরুদ্ধে ছেলেকে অপহরণ করে খুনের অভিযোগ করেন থানায়। পুলিশ কিন্তু তদন্তে সে রকম কিছু পায়নি। তখন বাঁকুড়া সিজেএম কোর্টে নালিশ ঠুকলেন গুণরাম। সিজেএমের নির্দেশে সিআইডি তদন্তে নামল। জেলে পুরল অভিযুক্ত সাত জনকে (যাঁদের মধ্যে আবার চার জন সে সময় স্কুলপড়ুয়া)। তিন বছর পরে চার্জশিট জমা দিয়ে জানিয়ে দেয়, ছেলেটিকে খুনের উদ্দেশ্যেই অপহরণ করা হয়েছে। পরাণবাবুদের ১৩ দিন আর বাড়ির ছেলেদের ৬ দিন জেলে কাটাতে হয়েছে। তার পর থেকে তাঁরা জামিনে ছাড়া ছিলেন। সেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া এখনও চলছে।

দক্ষিণপদ কিন্তু রৌরকেল্লা থেকে ২০০২ সালেই বাড়িতে ফিরে এসেছিল। ছেলেকে বেমালুম সব চেপে যেতে বলেন বাবা গুণরাম। বলে দেন, ‘কাউকে কিচ্ছু বলবি না। যেখানে আছিস, সেখানেই থাক! সবাই ভাববে তুই আর বেঁচে নেই!’ এই চিত্রনাট্যের কথা জানতেন পরিবারের সকলেই। এত দিন সবাই তা চেপে গিয়েছেন।

Advertisement

দক্ষিণপদ ফিরে যায় রৌরকেল্লাতেই। এর পরে গুজরাটে এক প্লাস্টিক কারখানায় বছর দশেক কাজ করার পরে সে ফিরে আসে বর্ধমানের রানিগঞ্জে। সেটা ২০১২ সাল। এই ১২ বছর সে মাঝমধ্যেই গ্রামের বাড়িতে আসত। প্রতিবেশীরা তাকে দেখেছেন। কিন্তু, তাঁরা গুণরামের মামলার বিষয়টি ভাল ভাবে জানতেন না বলে তাঁদের কখনও সন্দেহ হয়নি। দক্ষিণপদর বেঁচে থাকার খবর জানতেন না মঙ্গলদা গ্রামের পরাণ বাউরিরাও। তাঁরা আদালতে বারবার দাবি করেছেন, তাঁরা নির্দোষ। কিন্তু, তা গ্রাহ্য হয়নি। শেষে এ বছর ১৬ জুলাই আইনজীবীর পরামর্শে বাঁকুড়ার অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারকের (৩) এজলাসে পিটিশন জমা দেন পরাণবাবুরা। আবেদনে তাঁরা দাবি করেন, সিআইডি ঠিকমতো তদন্ত করেনি। পুনরায় ঘটনার তদন্ত হোক। বিচারক ছাতনা থানার পুলিশকে পুনর্তদন্তের নির্দেশ দেন।

আর তাতেই ফাঁস হল গুণরামের সাজানো চিত্রনাট্য!

গুণরাম অবশ্য বছর দুয়েক আগেই গত হয়েছেন। তদন্তে নেমে ছাতনা থানার ওসি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় জানতে পারলেন, দক্ষিণপদ বেঁচে আছে। এবং গ্রামের বাড়িতেই আছে। রবিবার রাতে পুলিশ গিয়ে ঘিরে ফেলে সেই বাড়ি। বছর তেইশের দক্ষিণপদকে নিয়ে আসে থানায়। পুলিশের সামনে গড়গড় করে সব বলে দেয় ওই যুবক। জানায়, বাবার সাজানো মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করতে এত বছর তাকে বাড়ি ছেড়ে বাইরে বাইরে কাটাতে হয়েছে। না হয়েছে পড়াশোনা, না পেয়েছে পরিবারের সান্নিধ্য। তার নিজের কোনও পরিচয়ই কার্যত নেই। না আছে রেশন কার্ড, না ভোটার কার্ড।

সোমবার দক্ষিণপদকে অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারকের (৩) এজলাসে হাজির করায় পুলিশ। সেখানে তখন উপস্থিত কয়েক জন অভিযুক্তও। বিচারকের সামনে সমস্ত সত্যি জানিয়ে দেয় দক্ষিণপদ। অভিযুক্তেরা যা শুনে হাঁ! বিচারক ওই যুবককে ফের ১৮ অগস্ট কোর্টে হাজির করার নির্দেশ দেন। দক্ষিণপদকে বাড়ি ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। অপহরণ করে খুনের মামলায় গুণরামের সরকারি আইনজীবী লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “সিআইডি চার্জশিটে ৩৬৪ ধারা (খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ) দিয়েছিল। কিন্তু, ১৪ বছর ধরে দক্ষিণপদর কোনও খোঁজ না মেলায় সবাই ধরে নিয়েছিলেন, সে খুনই হয়েছে।”

মঙ্গলবার বিকেলে বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে, পুরুলিয়ার কাশীপুর ব্লকের সীমানা ঘেঁষা ছোলাগড়া গ্রামে নিজের বাড়িতেই পাওয়া গেল দক্ষিণপদকে। বাড়িতে তখন ছিলেন ওই যুবকের দুুই দাদা, বৌদি আর ভাইপো-ভাইঝি। মা-ও মারা গিয়েছেন বছর খানেক আগে। দাদা, বৌদিরা অবশ্য দক্ষিণপদের সন্ধান দিতে বিস্তর তানাবানা করলেন। বেশ কিছুক্ষণ বাড়ির দাওয়ায় অপেক্ষা করার পরে ভিতর থেকে বেরিয়ে এল দক্ষিণপদ। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর ফুলপ্যান্ট। কেন গ্রাম ছেড়েছিলে? ওই যুবক বলল, “জমিটা নিয়ে রোজ বাবার সঙ্গে অশান্তি হত অন্যদের। আমি খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম।” ১৪ বছর আগে স্থানীয় এক গ্রামের বাসিন্দার হাত ধরেই বাড়ি ছেড়েছিল সে। দক্ষিণপদর কথায়, “রৌরকেল্লায় আমি সব্জি বিক্রি করতাম। কয়েক বছর আগে চলে যাই গুজরাটে। ওখানে আমার ছোড়দা কাজ করত প্লাস্টিক কারখানায়। দাদা আমাকেও কাজ জুটিয়ে দেয়। মাঝে মধ্যেই বাড়ি আসতাম। কিন্তু, বাবা বলত, বেঁচে আছি, কাউকে বলা যাবে না। এলাকায় বেশি ঘোরাঘুরি করতেও বারণ করত। এ রকম জীবন কাটাতে কাটাতে বিরক্তি এসে গিয়েছিল!”

দিন পনেরো আগে শরীর খারাপ হওয়ায় সে রানিগঞ্জের কারখানা থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে ফিরেছিল। পুলিশের কাছে সোর্স মারফত পৌঁছে গিয়েছিল সেই খবর। দক্ষিণপদর মেজদা ঈশান মণ্ডলের দাবি, “বাবা প্রথমে ভয় পেয়েই অপহরণ আর খুনের অভিযোগ করেছিল। তার পর ভাই ফিরে আসার পরে কী করবে বুঝতে না পেরে ভাইকে সমস্ত ঘটনা চেপে যেতে বলে। আমরাও কাউকে কিছু বলিনি।”

এ বার গন্তব্য মঙ্গলদা।সেখানে পাওয়া গেল বৃদ্ধ পরাণ বাউরি ও তাঁর পরিবারের অন্য ছয় সদস্যকে, যাঁরা এত বছর দক্ষিণপদকে অপহরণ ও খুনের অভিযোগ ঘাড়ে নিয়ে দিন কাটিয়েছেন। এত বছরে কত বার যে কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়েছে, তা আর তাঁদের কারও মনে নেই। অভিযুক্তদের মধ্যে পরাণবাবু ছাড়াও ছিলেন, তাঁর ভাই নারাণ, দাদা সতীশ, পরাণবাবুর বড় ছেলে নিমাই, নারাণবাবুর বড় ছেলে সুভাষ, মেজো ছেলে মধুসূদন ও ছোট সাধন। শেষের চার জন সেই সময় স্কুলপড়ুয়া। সিআইডি চার্জশিটে তাদের নামও ঢুকিয়েছিল। পরাণবাবুর ক্ষোভ, “একটা মিথ্যা অভিযোগে এত বছর আইন-আদালত করে করেই কেটে গেল। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেগুলোও জেল খাটল। মামলা চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার উপক্রম। আর আজ জানতে পারলাম, সেই ছেলে দিব্যি বেঁচে আছে!” কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেললেন নারাণবাবু। পরে সামলে নিয়ে বললেন, “আমরা কোর্টে বারবার নিজেদের নির্দোষ হওয়ার কথা বলেছি। কেউ তা শোনেনি। আদালত যদি আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে পুলিশকে ফের তদন্তের নির্দেশ না দিত, তা হলে হয়তো অপবাদ মাথায় নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হত।”

মঙ্গলদা গ্রামের পঞ্চাশ শতক সেই জমিটা এখনও আছে। সেখানে চাষ করেন পরাণবাবুর পরিবার। গুণরামবাবুর বড় দুই ছেলে অবশ্য জমির অধিকার ছাড়তে নারাজ। দক্ষিণপদ এখনও এই জমি-বিবাদে কোনও আগ্রহ নেই। তাঁর কথায়, “যে জমির জন্য এতগুলো বছর বাড়িছাড়া হয়ে থেকেছি, সেই জমির ব্যাপারে আমি মাথাই ঘামাতে চাই না!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement