নিহতের দেহ ঘিরে শোকার্ত পরিবার। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
সবে মাত্র মুখে ভাত তুলেছিলেন। হঠাৎই ঢুকে পড়ে জনা কয়েক যুবক। টেনে হিঁচড়ে, অকথ্য ভাবে চড় থাপ্পড় মারতে মারতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ওই প্রৌঢ়কে। ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারা হয় টাঙ্গির কোপ। মহকুমা হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই মৃত্যু হয় কানুর গ্রামের হতভাগ্য খেতমজুর রহিম শেখের।
রবিবার গ্রামের উত্তরপাড়ায় নিহত ওই বিজেপি সমর্থকের বাড়িতে পৌঁছে ঘটনার এমন বিবরণই মিলল। সকাল থেকেই সেখানে চাপা উত্তেজনা। বাড়তি গণ্ডগোলের আশঙ্কায় ইলামবাজার ওসি কাতির্র্কমোহন ঘোষের নেতৃত্বে পুলিশ এবং কম্ব্যাট বাহিনীর জওয়ানেরা গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঘটনার পর থেকেই গ্রামের বহু পুরুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে সকাল থেকেই রহিম শেখের আত্মীয়স্বজনেরা তাঁরা বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছিলেন। কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কেউ কেউ আর্জি জানাচ্ছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। তাঁদের দাবি, দলাদলি করে মানুষের জীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে সরকার অবিলম্বে ব্যবস্থা নিক। এরই মাঝে বিজেপির অন্যতম জেলা সম্পাদক চিত্তরঞ্জন সিংহ এবং দলের সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা গ্রামে ধিক্কার মিছিল বের করেন। সেখানে অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিও ওঠে।
রবিবার ইলামবাজারের কানুর গ্রামে পুলিশের টহল।
সদ্য সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া রহিম শেখ ছিলেন খেতমজুর। চার ছেলেমেয়ে আর স্ত্রী হাজারা বিবিকে নিয়ে তাঁর সংসার। রহিমের ভাগ্নি জিন্নাত বিবি জানান, বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে বছর খানেক আগেই। ছোট মেয়ে সামিনা এ বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণা হয়েছে। কিন্তু টাকার অভাবে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে পারেনি। একচিলতে বাড়িই সকলের মাথা গোঁজার ঠাঁই। অভিযোগ, প্রাক্তন সিপিএম সমর্থক, দিন আনি দিন খাই এই পরিবারকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের পরে নিরাপত্তা পেতে রহিম শেখের পরিবার-সহ গ্রামের বেশ কয়েকটি সিপিএম সমর্থক পরিবার বিজেপিতে যোগ দেয়। এলাকার বেশ কিছু দলীয় কর্মসূচিতে তাঁরা যোগ দেন। তারপরেই তৃণমূলের অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায় বলে অভিযোগ। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, দিন কয়েক আগে রহিমের আত্মীয় মিঠু শেখের কুড়িটি গোরু চুরি করে নেওয়া হয়। আর এক বিজেপি সমর্থক মাঝাই শেখের বাড়ি থেকে প্রকাশ্যে টাকাপয়সা, সোনাদানা লুঠ করা হয়। এই ভাবে একের পর ঘটনায় অত্যাচারের শিকার হতে শুরু করেন গ্রামের বিজেপি সমর্থক পরিবারগুলি। প্রত্যেকটিতেই তৃণমূল দুষ্কৃতীরা জড়িত বলে বিজেপির অভিযোগ।
গ্রামের বিজেপি সমর্থক পরিবারগুলির দাবি, বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার আর লুঠপাট চলছিলই। প্রতিবাদ করার বা থানায় যাওয়ার কোনও উপায়-ও ছিল না। পুলিশ-প্রশাসন তাঁদের, থানায় গেলে বিপদ আরও বাড়বে বলেই তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা হুমকি দিতেন বলে ওই পরিবারগুলির দাবি। জিন্নাত বলেন, “শনিবার আমরা কোনও মতে ঘরবাড়ি ছেড়ে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি। ওই সময়ই মামা আক্রমণের মুখে পড়ে। সকলের সামনে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। বারবার আমরা থানায় ফোন করেছি। থানা ফোন নামিয়ে রেখে দিয়েছে। কোনও সাহায্য পাইনি।” অভিযোগ, রহিম শেখকে এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে খুন করা হয়। তাঁর স্ত্রী বলেন, “চিৎকার করে ওদের কত করে বললাম, আমার স্বামীটাকে ছেড়ে দাও। ও নিরীহ মানুষ। কেউ কথা শুনল লা। মানুষটাকে ভাতটাও খেতে দিল না। পুলিশের সামনেই কুপিয়ে কুপিয়ে তৃণমূলের লোকেরা ওকে খুন করে দিল।”
বেলা দেড়টা নাগাদ একটি পিকআপ ভ্যানে গ্রামে ঢুকল নিহত রহিম শেখের দেহ। তাঁর বাড়িতে ততক্ষণে জনতা ফেটে পড়েছে। বাড়ির উঠোনে দেহ রাখতেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন নিহতের স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা। নিহত দলীয় সমর্থকের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য নেতা শমীক ভট্টাচার্য-সহ প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যেরা। রহিমের দেহে মালা রেখে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন। পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন। সেই আশ্বাসে অবশ্য শান্তি মিলছে না ওই হতভাগ্য গরিব পরিবারের। বিকেলে বাড়ির কাছেই সমাধিস্থ হওয়ার আগে স্বামীর নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে ভেসে আসছিল, হাজারা বিবির স্বগোতোক্তি, “পুলিশ যদি একটু দেখত। তোমাকে এ ভাবে চলে যেতে হত না গো...।”