জল মিলবে কবে? প্রকল্পের কল। —নিজস্ব চিত্র
কল আছে, জল নেই!
এক বালতি জলের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে হাপিত্যেশ চলে সকাল থেকেই। হাঁপিয়ে উঠতে হয় কল পাম্প করতে। অথচ, গভীর নলকূপ রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যায়। জল নিয়ে এই হা-হুতাশের ছবি খয়রাশোলের।
এক কলে জল না মিললে খোঁজ পড়ে ভিন পাড়ায়, অন্য কলের। যে সব নলকূপে এখন ভাল জল মিলছে কোনও গ্যারান্টি নেই দু’চার মাস বাদে একইভাবে জল মিলবে সেখান থেকে। ঘটনা হল, বর্ষাকাল পার হলেই জলের এই সমস্যা মাথাচারা দেয় খয়রাশোলে। পানীয় জলের জন্য হা হুতাশ বাড়তেই থাকে।
কাগজে-কলমে খয়রাশোলের এই ছবি বছর খানেক আগেই বদলে গিয়েছে। কারণ অজয় নদ থেকে জল তুলে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের যে প্রকল্পের মাধ্যমে খয়রাশোল-সহ বাকি ১৭টি মৌজায় জল দেওয়ার কথা, সেই প্রকল্পে এখন জল যায় মাত্র ১টি মৌজায়। নদ থেকে জল উঠছে, জলাধারে জল জমা হচ্ছে, পাইপলাইন পাতা হয়েছে, স্ট্যান্ড কল বা স্ট্রিট কানেকশনও বসানো হয়েছে অথচ এলাকায় জল এখনও পৌঁছয়নি। কেন পৌঁছয়নি, তার সদুত্তর দিতে নেই কারও কাছেই।
সংশিষ্ট দফতর বলছে, সবকিছু হয়ে গেলেও বেশ কয়েক জয়গায় জলবাহী পাইপ ফেটেছিল। স্থানীয় বাধায় তা মেরামতি করা যায়নি। সেই কারণেই জল পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছে না। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যা মেটার লক্ষণ নেই। ব্লক প্রশাসন ও এলাকাবাসীর কথায়, পাথুরে এলাকা হওয়ার জন্য গভীর নলকূপ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বর্ষার কয়েকটি মাস বাদ দিলে এলাকার অধিকাংশ পুকুরেই জল থাকে না। শুকিয়ে যায় কুয়োর জলও। তখন ভরসা বলতে এলাকার গভীর নলকূপগুলি।
কিন্তু সমস্যা সেখানেও। তাই পানীয় জলের জন্য চরম অসুবিধায় পড়তে হয় খয়রাশোল গ্রামের প্রায় হাজার সাতেক মানুষকে। এর সঙ্গে জলে অতিরিক্ত আয়রন ও ফ্লোরাইডের সমস্যাও রয়েছে। যদিও এই সমস্যা শুধুমাত্র খয়রাশোল গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়। ছড়িয়ে রয়েছে খয়রাশোলের আরও বেশ কয়েকটি পঞায়েত এলাকায়। খয়রাশোলের বিডিও মহম্মদ ইসরার বলছেন, “সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য নদী থেকে পরিস্রুত পানীয় জল দেওয়ার ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেটাও এখনও হয়ে উঠল না।”
জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম থেকেই প্রকল্প রূপায়নে নানা সমস্যা। ৬.৬৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। ২০১০ সালে কাজও শুরু হয়। অজয় নদে ৬টি গভীর নলকূপের সাহায্যে জল তুলে জমা করার জন্য অজয়ের ধার ঘেঁষা চূড়র মৌজয় তৈরি হয় ২ লক্ষ ৭০ হাজার লিটার জল ধারণের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জলাধার। ৩ লক্ষ ৮২ হাজার লিটার জলধারণের ক্ষমতাসম্পন্ন অন্য জলাশয়টি করা হয় খয়রাশোলে। কিন্তু অজয় থেকে চূড়র জলাধার পর্যন্ত পাইপ লাইন পাতার সময়ই বাধা পেতে হয় সংশ্লিষ্ট দফতরকে।
ঠিক হয়েছিল, প্রথমে অজয় নদ থেকে জল তুলে পাঠানো হবে চূড়র জলাধারে। সেখান থেকে পরিস্রুত পানীয় জল পাইপ লাইনের মাধ্যমে পাঠানো হবে খয়রাশোলের জলাধারে। সেই জলাধার থেকেই কেন্দ্রগড়িয়া, পানসিউড়ি, নাকড়াকোন্দা, হজরতপুর-সহ ১৮টি মৌজার ৩৩টি গ্রামে জল পৌঁছনোর কথা ছিল। কিন্তু অজয় থেকে চূড়র জলাধার পর্যন্ত ৩০০মিটার পাইপ লাইন বসানোর ক্ষেত্রেই আপত্তি তুলেছিলেন চাষিদের একাংশ। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছিল, ওই ৩০০ মিটারের কিছুটা অংশ খাস জমি। বাকি অংশের মালিক আটজন চাষি। ছ’জন আপত্তি না করলেও দু’জন তাঁদের জমির নীচে পাইপ বসাতে দিতে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত প্রশাসন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে গতবছর সবার কাছ থেকে ছাড়পত্র মিলেছিল। কাজও শেষ হয়েছিল। কিন্তু এবার ভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়েছে। কী সমস্যা? শুক্রবার পর্যন্ত ওই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সহকারি ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জিত বলেন যে সময় প্রকল্পের ভাবনা হয়েছিল তখন মাটির নীচে, পিভিসি-র বদলে সিমেন্টের তৈরি পাইপ বসানোই রেওয়াজ ছিল। সেই মত নির্দেশিকা এবং বরাদ্দ মিলেছিল।
পড়ে রয়েছে পাইপ।
ঘটনা হল, সিমেন্টের তৈরি(এসি পাইপ) পাইপের সমস্যা হচ্ছে জল পাঠানো শুরু হলেই জলের প্রেসারের জন্য প্রথম দিকে তা জায়গায় ফেটে যায়। তা মেরামত করে কিছুদিন ধরে ওই পাইপের মধ্যে জল পাঠিয়ে পাইপটিকে উপযোগী করে নিতে হয়। তারপর সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এক্ষেত্রে জল চার্জ করলে যেখানে যেখানে পাইপ ফাটছে, মেরামত করতে দেরি করছে সংশ্লিষ্ট দফতর। এতে, এলাকার মানুষ বলছে রাস্তা কাটা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিচ্ছে না। সমস্যা এখানেই জটিল আকার নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরা বলছেন, প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যাওয়ার কারণে যে সব রাস্তার আগে মোরাম বা কাঁচা রাস্তা ছিল, তার পরিবর্তে অনেক রাস্তাই কংক্রিটে বা ঢালাইয়ের হয়েছে। ফলে পাইপে ফাটল ধরা পড়লেও ঢালাই কেটে তা মেরামত করে ফের ঢালাই করে দেওয়ার মত বরাদ্দও নেই। ঠিকাদাররা তা করতেও চাইছেন না। আবার রাস্তা আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে সময় লাগলেও এলাকার মানুষ তা মানতে চাইছেন না।
এ দিকে বর্তমানে চূড়র থেকে খয়রাশোল জলাধারে আসার পথে তিন জায়াগায় বাধা পেতে হয়েছে বলে পিএইচই-র দাবি। যদিও দাবির সঙ্গে একমত নন খয়রাশোলের বিডিও মহম্মদ ইসরার। একই কথা বলছেন খয়রাশোল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের অসীমা ধীবরও। তিনি বলেন, “স্থানীয় বাধায় আটকে যাচ্ছে কাজ, এমন কোনও কথাই পিএইচই আমাদের জানায়নি। তাহলে সমাধান করব কী ভাবে।”
পিএইচই-র কর্তারা বলছেন জেলা উন্নয়ন বৈঠকে এলাকা থেকে নির্বাচিত জেলাপরিষদের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ বিকাশ কর্মাধ্যক্ষ নবগোপাল বাউড়িকে সে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নবগোপালবাবুও সে দাবি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “পিএইচই স্পষ্ট করে তেমন কিছু বলেনি। কোথায় বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বললে আমি সঙ্গে যাব।” প্রশাসনিক চাপানউতোর নিয়ে অবশ্য মাথা ঘামাতে রাজি নন খয়রাশোলের নিরুপা বাউড়ি, কেকা সরকার, চিত্রা ঘোষ বা বর্ণালী ঠাকুরেরা। তাঁরা বলছেন, বাড়ির কাছের নলকূপ থেকে ভাল জল পাই না তাই বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে পানীয় জল আনতে হয়। সমস্যা যাই থাক তা মিটিয়ে, জল আসুক খয়রাশোলে, এমনটাই চাইছেন তাঁরা।
জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতেরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অর্ধেন্দু দত্ত বলেন, “সমস্যা মিটিয়ে শীঘ্রই জল পৌঁছে দেব।” কিন্তু কবে এবং কী ভাবে সেটা স্পষ্ট করেননি ওই আধিকারিক। সুতরাং জল নিয়ে আতঙ্ক রয়েই গেল খয়রাশোলে।