লাভপুরে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর দু’টি সাবমার্সিবল পাম্প। —নিজস্ব চিত্র
সামান্য সাবমার্সিবল পাম্পের জল বিক্রিকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এল লাভপুরে। দলীয় বিধায়ক মনিরুল ইসলামের গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁরই রাজনৈতিক গুরু হিসেবে পরিচিত আব্দুল মান্নান গোষ্ঠীর কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে গত কয়েকদিন ধরে তেতে রয়েছে লাভপুরের বলরামপুর গ্রাম। মঙ্গলবার দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিতে জখম হন এক গৃহবধূ। জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “কেউ গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে জানা নেই। তবে কয়েকদিন আগে ওই গ্রামে ঝামেলা হয়েছে। দু’পক্ষই অভিযোগ দায়ের করেছে। এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। অভিযুক্তদের খোঁজে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে।”
লাভপুরে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর তৃণমূলে যোগ দেন ফব-র দাপুটে নেতা তথা স্থানীয় দাঁড়কা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান মনিরুল ইসলাম। তৃণমূলে জেলা সহ-সভাপতির পদ পান তিনি। পরবর্তীকালে দলের তৎকালীন জেলা সম্পাদক তথা বিধানসভা আসনের অন্যতম দাবিদার দেবাশিস ওঝাকে টেক্কা দিয়ে টিকিট জোগাড় করেন মনিরুল। তখন থেকেই মনিরুল গোষ্ঠীর সঙ্গে দেবাশিস গোষ্ঠীর বিবাদ চরমে ওঠে। সিপিএম এবং ফব থেকে বিভিন্ন সমাজবিরোধীদের দলে ঢুকিয়ে দেবাশিস তথা আদি তৃণমূল কর্মী সমর্থকদের মনিরুল কোনঠাসা করে ফেলেন বলে অভিযোগ। ওই সব সমাজবিরোধীদের কাজে লাগিয়েই মনিরুল বিধানসভা এমনকী লাভপুর এলাকার সমস্ত পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতেন বলেও বিরোধীদের অভিযোগ। তবুও দু’পক্ষের দ্বন্দ্ব থামেনি। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসেই মনিরুল মদতপুষ্ট প্রাক্তন সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতী গোপাল শেখ এবং তার লোকেদের গুলিতে খুন হন দেবাশিস ওঝার অনুগামী হিসেবে পরিচিত দলের বিপ্রটিকুরি বুথ কমিটির সভাপতি চিত্তরঞ্জন মণ্ডল।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, লাভপুরে তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পায় বিধানসভা নির্বাচনের পর। বিধায়ক হওয়ার পর মনিরুল তাঁর রাজনৈতিক গুরু ফব-র তদানিন্তন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল মানান্নকে দলে ঢোকান। তাঁরই সঙ্গে ঢোকেন ফব-র বেশ কিছু কর্মীসমর্থকও। উপহার হিসেবে তৃণমূলে জেলা সহ-সভাপতির পদ এবং লাভপুরে যাবতীয় কাজে ভাবশিষ্যের বকলমে পান গুরু। এর ফলে মনিরুলের হাত ধরে দলে ঢোকা কর্মীরা তুলনায় কিছুটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। তাঁদের সঙ্গে মান্নান অনুগামীদের বিরোধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। গত এপ্রিল মাসে স্থানীয় বামনিগ্রামে মনিরুল অনুগামীদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে দুই মান্নান অনুগামীর মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ।
বলরামপুরেও গুরু-শিষ্যের অনুগামীদের মধ্যে বিরোধ বেধেছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা তথা স্থানীয় ঠিবা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন কংগ্রেস প্রধান আলিমুদ্দিন শেখ বিধায়কের হাত ধরে সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর তৃণমূলে ঢোকেন। পরবর্তীকালে মান্নানের হাত ধরে সিপিএম কর্মী হিসেবে পরিচিত নুর আলি তৃণমূলে ঢোকেন। দিন চারেক ধরে সাবমার্সিবল পাম্পের জল বিক্রি নিয়ে দুই গোষ্ঠীর বিবাদে তেতে ওঠে ওই গ্রাম। এলাকার বাসিন্দারা জানান, নিজেদের চাষের পাশাপাশি এলাকায় এখন জল বিক্রি এক রকম ভালো ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে ৩০-৪০ বিঘা জমির সেচের জল মেলে একটি পাম্প থেকে। বিঘা প্রতি দু’টি চাষের জল দেওয়ার জন্য ভাড়া মেলে ১৮০০-২০০০ টাকা। আলিমুদ্দিন এবং নুর আলিদের ১টি করে পাম্প রয়েছে স্থানীয় কাঁদরকুলো মৌজায়। কিন্তু বিল বকেয়া থাকার জন্য কিছুদিন আগে নুর আলির পাম্পের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় বিদ্যুৎ দফতর। তখন তাঁর ভাড়াটিয়া চাষিরা আলুমুদ্দিনের কাছ থেকে জল নেওয়া শুরু করে।
অভিযোগ, নুর আলি ওই সব চাষিদের জল দিতে বারণ করেন আলিমুদ্দিনকে। নুরের যুক্তি ছিল, কিছুদিন পরেই সংযোগ মিলবে। তা ছাড়া, ওই সব চাষিদের কাছে টাকা পাওনা রয়েছে। অন্য জায়গা থেকে জল নিয়ে ওই সব চাষিরা বকেয়া টাকা দেবেন না। কিন্তু আলিমুদ্দিন নুরের কথা শোনেননি বলে দাবি গ্রামবাসীদের। সেই রাগে দিন চারেক আগে নুর আলিমুদ্দিনের পাম্পঘরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাঁর বাবা আসগর শেখকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। পাল্টা মারধরের অভিযোগ ওঠে আলিমুদ্দিনের বিরুদ্ধেও। মঙ্গলবার সকালে ফের উভয় পক্ষের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। চলে গোলাগুলি। আব্দুল মান্নান বলেন, “অসুস্থতার কারণে সিউড়িতে রয়েছি। এ বিষয়ে কিছু বলব না। যা জানার ব্লক সভাপতির কাছ থেকে জেনে নিন।” ব্লক সভাপতি তরুণ চক্রবর্তীও এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
এ দিনের ঝামেলার মাঝে পড়ে নাসপাতি বিবি নামে গৃহবধূর ডান পায়ে গুলি লাগে। তাঁকে লাভপুর গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁর স্বামী লাল্টু শেখ বলেন, “আমার স্ত্রী পড়শির বাড়িতে যাচ্ছিল। ওই ঝামেলার মাঝে পড়ে তার প্রাণ সংশয়ের উপক্রম দেখা দেয়।” ঘটনার পরে বার বার ফোন করা হলেও ফোন ধরেননি বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। এসএমএস-এর জবাবও দেননি তিনি। এ দিন দুপুরে এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, কার্যত পুরুষশূন্য গ্রাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বললেন, “পুলিশ ধরপাকড়ের নামে আমাদের বাড়িতে বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে।” ভাঙচুরের নমুনা মিলল, ডালিম শেখ, বদর শেখ, আইনাল শেখ, মিলন শেখদের বাড়িতে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ভাঙা আসবাবপত্র, গৃহস্থালির সামগ্রী, ধান কিংবা চাল। পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন এসপি অলোক রাজোরিয়া।