পৌঁছচ্ছে না কংসাবতী, শুকোচ্ছে খেত

বৃষ্টি কম হওয়ায় এ বার ধান চাষের লক্ষমাত্রার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেনি বাঁকুড়া জেলা। সেচ ব্যবস্থা তুলনামূলক ভাল হওয়ায় জেলার তিন মহকুমার মধ্যে বিষ্ণুপুরের হাল একটু ভাল। তবে মুখ থুবড়ে পড়েছে বাঁকুড়া সদর ও খাতড়া মহকুমা। এর মধ্যে বাঁকুড়া সদরে সেচ ব্যবস্থা কার্যত নেই। কিন্তু কংসাবতীর সৌজন্যে খাতড়া মহকুমার ৮টি ব্লকের বেশিরভাগ অংশই সেচের জল পেয়ে থাকে। তার পরেও এই মহকুমার এহেন দুর্দশা দেখে প্রশ্ন উঠছে বিস্তর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৪৪
Share:

সেচের জল আসেনি। শুকোচ্ছে ধান খেত। রাইপুর এলাকায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

বৃষ্টি কম হওয়ায় এ বার ধান চাষের লক্ষমাত্রার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেনি বাঁকুড়া জেলা। সেচ ব্যবস্থা তুলনামূলক ভাল হওয়ায় জেলার তিন মহকুমার মধ্যে বিষ্ণুপুরের হাল একটু ভাল। তবে মুখ থুবড়ে পড়েছে বাঁকুড়া সদর ও খাতড়া মহকুমা। এর মধ্যে বাঁকুড়া সদরে সেচ ব্যবস্থা কার্যত নেই। কিন্তু কংসাবতীর সৌজন্যে খাতড়া মহকুমার ৮টি ব্লকের বেশিরভাগ অংশই সেচের জল পেয়ে থাকে। তার পরেও এই মহকুমার এহেন দুর্দশা দেখে প্রশ্ন উঠছে বিস্তর।

Advertisement

কৃষি দফতর সূত্রে খবর, খাতড়া মহকুমায় যে পরিমাণ আমন ধান বীজ লাগানো হয়েছিল তার মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশ ফসলই জলের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে। এর কারণ, হিসেবে কংসাবতীর জল সঠিক সময়ে জমিতে না পৌঁছনোকেই দায়ী করছে প্রশাসনিক মহল। কৃষি দফতরের দাবি, চলতি মাসের ২ তারিখ জল ছেড়েছে কংসাবতী। ততদিনে এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। আবার জল ছাড়ার এক সপ্তাহ পরেও বহু জমিতেই জল পৌঁছয়নি। জেলা উপকৃষি আধিকারিক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “বারবার বলার পরেও কংসাবতী সেচ বিভাগ সঠিক সময়ে জল ছাড়েনি। শেষে রাজ্য কৃষি দফতর, জেলাশাসক ও জেলা সভাধিপতির কথায় চাপে পড়ে জল ছাড়ে। কিন্তু এখনও নীচু জমিগুলিতে জল নামেনি বলে খবর আসছে।” তিনি জানাচ্ছেন, খাতড়া মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসল একেবারেই নষ্ট হতে বসেছে। এই পরিস্থিতিতে ধান বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই কথা বলেন রাইপুর ব্লকের সহ-কৃষি আধিকারিক সৌমেন মণ্ডল। তিনি বলেন, “এই ব্লকের প্রায় ৬০ শতাংশ জমির ধান মরতে বসেছে। বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছেন কৃষকেরা। চাষের মরশুম শুরু হওয়ার আগে আমরা বারবার সেচ খাল সংস্কারের কথা বলেছিলাম। কিন্তু কংসাবতীর কর্তাদের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।”

এ দিকে, মাঠেই ফসল মরতে দেখে মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে জঙ্গলমহলের চাষিদের। সারেঙ্গা ব্লকের চিলতোড় গ্রামের চাষি সত্যজিত্‌ মহাপাত্র সাত বিঘা জমিতে আমন ধান লাগিয়ে ছিলেন। ছ’বিঘা জমির ধান নষ্টের মুখে। জলের অভাবে তাঁর জমি ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছে। হাজার হাজার টাকার ফসল চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখে কংসাবতী সেচ দফতরের অব্যবস্থাকেই দুষছেন তিনি। একই অবস্থা এই গ্রামের চাষি শান্তিনাথ মিশ্রেরও। ১৫ বিঘা জমিতে আমন লাগিয়েছেন। মাত্র সাড়ে তিন বিঘা জমির ধান বেঁচে রয়েছে। শান্তিনাথবাবু, সত্যজিত্‌বাবুদের ক্ষোভ, “সেচ খাল মজে গিয়েছে। এতে উপরের দিকের জমিগুলিতে যদিও জল গিয়েছে, নীচু জমিতে জল নামছে না। ফসল ঘরে তুলতে পারার আশা ছেড়েই দিয়েছি।” সময় পেরিয়ে গিয়েছে। তাই জল পেলেও আর ধান বাঁচানো সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও সন্দিহান তাঁরা। ভাগ চাষিদের অবস্থা আরও খারাপ। অন্যের জমি ভাগ নিয়ে ঋণ নিয়ে টাকা-পয়সা চাষের কাজে লাগিয়েছিলেন সারেঙ্গার বারপাখান গ্রামের রঘু দুলে। জলের অভাবে তাঁর পাঁচ বিঘা জমির ধান নষ্ট হতে বসেছে। একই অবস্থা এই গ্রামের অন্য ভাগচাষি পূর্ণচন্দ্র দুলে, বিবেক ধর, সুধাকর সরঙ্গীর মতো অনেকের। জেলার জঙ্গলমহলের ৪টি ব্লক-সহ গোটা খাতড়া মহকুমারই কম বেশি এই হাল। চাষিদের প্রশ্ন, সময় মতো জলই যদি না পেলাম, তা হলে সেচ থেকেই কি লাভ?

Advertisement

খতিয়ান

• বাঁকুড়া সদর মহকুমা

লক্ষ্যমাত্রা: ১ লক্ষ ৫২ হাজার ৮৪৬

হয়েছে: প্রায় ৭৮ হাজার

• বিষ্ণুপুর মহকুমা

লক্ষ্যমাত্রা: ১ লক্ষ ২২ হাজার ৭৭৪

হয়েছে: প্রায় ১ লক্ষ ১৫ হাজার

• খাতড়া মহকুমা

লক্ষ্যমাত্রা: ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ২২৭ হয়েছে: প্রায় ১ লক্ষ

* সমস্ত হিসেব হেক্টরে।

সেচ খাল মজে যাওয়ায় জল জমিতে পৌঁছচ্ছে না সে কথা মেনে নিচ্ছেন কংসাবতীর কর্তারাও। তবে সঠিক সময়ে জল না ছাড়ার অভিযোগ মানতে নারাজ তাঁরা। দফতরের খাতড়া মহকুমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়র সৌরভ দাস বলেন, “বৃষ্টি কম হওয়ায় জলস্তর বাড়েনি। তবে চাষিদের দাবি মতো দু-দফায় এ বার জল ছাড়া হয়েছে। জমি শুকনো হয়ে যাওয়ায় জল পৌঁছতে দেরি হচ্ছে। এ ছাড়া বেশ কিছু সেচ খাল মজে যাওয়াতেও জলের গতি ধাক্কা খাচ্ছে।” মজে যাওয়া সেচ খালগুলি সংস্কার করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “আমরা সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছি। পরিকল্পনার খসড়া করে দফতরে পাঠিয়েছি। কিছু পরিকল্পনা পাস হয়েছে, কিছু হয়নি। যে সব পরিকল্পনা পাস হয়েছে সেগুলিতে দ্রুত কাজ শুরু হবে।”

এ দিকে জেলা জুড়েই বৃষ্টির অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে কৃষি। খরা ঘোষণার দাবি তুলেছে রাজনৈতিক সংগঠনগুলি। অগ্রগামী কিষান সভার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মানিক মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “খরা ঘোষিত হওয়া মৌজাগুলির তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং ওই মৌজাগুলির চাষিরা কী সুবিধা পাবে তাও জনসমক্ষে জানাতে হবে জেলা প্রশাসনকে।” জেলাশাসক বিজয় ভারতী অবশ্য বলেন, “যে সমস্ত মৌজায় ৬০ শতাংশের কম ফলন হয়েছে সেগুলি খতিয়ে দেখে খরা ঘোষণা করা হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement