তৈরি কটেজ, খুলবে কবে কেউ জানে না

নীল আকাশের কোলে সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা একটি পাহাড়। পাথুরে পথ চলে গিয়েছে চূড়োয়। চড়াই ভাঙার ফাঁকে পা থামলে কানে ভেসে আসে কত পাখির ডাক। পাহাড়ের নীচে ঝিরঝিরে ঝর্ণার জল। শিল্পীরা পাথরে ছেনি, হাতুড়ি ঠুকে তৈরি করছেন অসামান্য সব শিল্প। এ ভাবেই পর্যটকদের কাছে পরিচিত শুশুনিয়া। ছাতনা ব্লকের এই পাহাড়ের আকর্ষণে দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসেন। কিন্তু সাঁঝ নামলেই সেখান থেকে পাততাড়ি গুটোতে হয় তাঁদের। এখানে থাকা যায় না? হামেশাই এ প্রশ্ন শুনতে হয়।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছাতনা শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩৫
Share:

শুশুনিয়ার পাহাড় কোলে তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে ‘মুরুবাহা ইকো পার্ক’। দরজা এখনও খোলেনি।

নীল আকাশের কোলে সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা একটি পাহাড়। পাথুরে পথ চলে গিয়েছে চূড়োয়। চড়াই ভাঙার ফাঁকে পা থামলে কানে ভেসে আসে কত পাখির ডাক। পাহাড়ের নীচে ঝিরঝিরে ঝর্ণার জল। শিল্পীরা পাথরে ছেনি, হাতুড়ি ঠুকে তৈরি করছেন অসামান্য সব শিল্প।

Advertisement

এ ভাবেই পর্যটকদের কাছে পরিচিত শুশুনিয়া। ছাতনা ব্লকের এই পাহাড়ের আকর্ষণে দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসেন। কিন্তু সাঁঝ নামলেই সেখান থেকে পাততাড়ি গুটোতে হয় তাঁদের। এখানে থাকা যায় না? হামেশাই এ প্রশ্ন শুনতে হয়।

গত কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সরকারি ভাবে এখানে থাকার বিশেষ কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ সময়ে বন দফতর শুশুনিয়ার পাহাড়তলিতে কয়েকটি কটেজ তৈরি করে। কিন্তু তাও প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। ফলে সবার ঠাঁই হয় না। সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর একটি পরিদর্শন বাংলো চালু করলেও তাতে এখনই তো সাধারণের জায়গা হবে না। ভরসা তাই তৈরি হয়ে পড়ে থাকা ‘মুরুবাহা ইকো পার্ক’। কিন্তু তার দরজা বন্ধ। তৈরি করেও স্রেফ ‘টেন্ডার’ না হওয়ায় পর্যটনের মরসুম শুরুর মুখেও ওই পার্ক খোলা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পর্যটকেরা। অনিশ্চিয়তায় পর্যটনের উপর নানা ভাবে নির্ভরশীল স্থানীয় মানুষজন। যদিও ছাতনার বিডিও সুতপা নস্কর ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মৌসুমি মিশ্রর দাবি শীঘ্রই ওই ইকো-পার্কের দরজা সবার জন্য খুলে দেওয়া হবে।

Advertisement

রাজ্যে পালা বদলের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুশুনিয়ার হাল ফেরানোর আশ্বাস দিয়েছেন একাধিকবার। ২০১১ সাল থেকে প্রশাসনিক উদ্যোগে পাহাড়তলিতে ‘মুরুবাহা ইকো পার্ক’ গড়ার কাজ শুরু হয়। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ, একশো দিন কাজের প্রকল্প, বিধায়কের এলাকা উন্নয়নের তহবিলের মতো বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা সংগ্রহ করে প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এই পার্ক গড়া হয়। পার্কের ভিতরে রয়েছে মোট ন’টি কটেজ। থাকছে রেস্তোরাঁ, পার্ক। এলাকার অপরূপ হস্ত শিল্প প্রদর্শনের জন্য একটি মিউজিয়ামও তৈরি করা হয়েছে এই পার্কে। চারপাশ সবুজ ঘাস ও গাছপালায় সাজিয়ে তোলা হয়েছে। যদিও এই কাজের মন্থর গতি নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের আক্ষেপ, পর্যটকদের এখানে ধরে রাখার মতো উপযুক্ত পরিকাঠামোর থাকার জায়গা গড়ে দেওয়ার দাবি দীর্ঘদিনের। পর্যটকরা বেশিক্ষণ থাকলেই কেনাকাটি করবে। এরফলে স্থানীয়দের রোজগারও বাড়বে।


জালে ঘেরা রাজা চন্দ্রবর্মার শিলালিপি। দেখতে যাওয়ার কোনও পথ নির্দেশও নেই।

একই ভাবে পর্যটকরাও দাবি করতেন, কেন এত সুন্দর জায়গায় থাকার ব্যবস্থা নেই? তা হলে রাস্তার ধকল কাটানোর জন্য রাতে নিশ্চিন্তে পাহাড়ের নীচে একটি সাজানো গোছানো ঘরে ঘুমাতে পারতাম। যেমন টালিগঞ্জের সৌরভ কর, দুর্গাপুরের মলয় নন্দীর আক্ষেপ, “কয়েকবছর আগে শুশুনিয়ায় বেড়াতে গিয়ে ভালো মানের খাবার হোটেল পাইনি। রাতে থাকার ভালো ব্যবস্থা না থাকায় পথের ধকল সহ্য করে বাঁকুড়া শহরে ফিরতে হয়েছিল।” কিন্তু এ বার শীতের ছোঁয়া পড়তেই একে একে পর্যটকদের আনাগোনা শুশুনিয়ায় বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু থাকার জায়গা না পেয়ে আক্ষেপ নিয়ে তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন।

তবে ছাতনার বিডিও-র আশ্বাস, “কটেজ, রেস্তোরাঁ ও হস্ত শিল্প প্রদর্শনীর মিউজিয়াম বেসরকারি সংস্থাকে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। তাই টেন্ডার ডাকা হয়েছে। আশা করছি চলতি মরসুমেই পার্ক পুরোদমে খুলে দেওয়া যাবে।” পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিও জানিয়েছেন, “ইকো পার্ক চালু করার কাজে গতি এসেছে। এ বার থেকে শুশুনিয়ায় আসা পর্যটকদের আর থাকতে না পারার দুঃখ নিয়ে ফিরে যেতে হবে না।” ছাতনা কেন্দ্রের বিধায়ক শুভাশিস বটব্যাল আশার কথা শুনিয়েছেন, “ওই ইকো পার্কের সঙ্গে একটি যুব আবাসও আমরা শীঘ্রই চালু করতে চলেছি। সেখানে প্রায় ৭০ জনের থাকার জায়গা হবে।” তিনি জানান, ধাপে ধাপে শুশুনিয়াকে ঘিরে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে আরও কিছু প্রকল্প চলছে।

সমস্যা আরও রয়েছে। এই পাহাড়েই রয়েছে রাজা চন্দ্রবর্মার শিলালিপি। কিন্তু অতি দুর্গম পথ হওয়ায় সেই শিলালিপি অনেকেই দেখতে যেতে পারেন না। আবার প্রশাসনের তরফে শিলালিপির রাস্তায় কোনও দিক নির্দেশিকা না করে দেওয়ায় এবং ওই শিলালিপি সম্পর্কে তথ্য সম্বলিত বোর্ড না থাকায় অনেকে জানতেই পারেন না চন্দ্রবর্মার শিলালিপির কথা। যাঁরা শুনেছেন, পথ খুঁজে তাঁদেরও অনেকের সেখানে পৌঁছনো সম্ভব হয় না। ইতিহাস সচেতন মানুষজনের কাছে জানা যায়, রাজস্থানের রাজপুতনার রাজা চন্দ্রবর্মা বাংলা জয়ের পরে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে এই শিলালিপি শুশুনিয়া পাহাড়ের পাথরে খোদাই করা হয়। শিলালিপিতে একটি বিষ্ণুচক্র রয়েছে।

বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের অধ্যাপক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওই শিলালিপির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। কিন্তু অতি অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হতে বসেছে।” বাঁকুড়ার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকেদের অনেকে জানতেই পারেন না শিলালিপির কথা। একটা বোর্ডেও লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কয়েক বছর আগে স্থানীয় যুবকের সাহায্য নিয়ে কোনওরকমে ওই শিলালিপির কাছে পৌঁছেছিলাম। কিন্তু সে সৌভাগ্য ক’জনের হয়? প্রশাসনের কাছে দাবি, ওই রাস্তা সুগম করা হোক।”

তবে এ সবের মধ্যে স্বস্তির কথা, বাঁকুড়া থেকে ছাতনা হয়ে শুশুনিয়া যাওয়ার রাস্তা কয়েকমাস আগে পর্যন্ত খারাপ ছিল, সম্প্রতি সংস্কার হয়েছে। গতবার রাস্তার হালে অনেক পর্যটককে ক্ষোভ জানাতে দেখা গিয়েছিল। এ বার ওই রাস্তা দিয়েই পর্যটকদের ঢল নামার দিন গুনছে শুশুনিয়া।

ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement