হাসপাতাল চত্বরে জমে রয়েছে আবর্জনার স্তূপ। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
দৃশ্য এক: উপরে করোগেটেড টিনের ছাউনি। যা সূর্যের তাপে তেতে বোম। সেই তেতে থাকা ছাউনির নীচেই আউটডোর। সেখানে পুরুষ-মহিলার গিজগিজ ভিড়ে পা ফেলারও জায়গা নেই। চিকিৎসা করাতে এসে লাইনে অপেক্ষমাণ রোগীদের পরনের পোশাক ঘামে ভিজে একশা। তাঁদের ক্ষোভ, দিন বদলাল, কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের টিনের ছাউনি আর পাকা ছাদ হল না।
দৃশ্য দুই: স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওয়ার্ডে শয্যার তুলনায় মেঝেতে রোগীর সংখ্যা বেশি। অবস্থা এমনই যে পা ফেলাই দায়! মেপে পা না ফেললে সোজা রোগীর ঘাড়ের উপরে পড়ে যেতে পারে পা। পুরুষ বা স্ত্রী সব ওয়ার্ডেই এই ছবি।
দৃশ্য তিন: স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চত্বরে অবাধ আনাগোনা কুকুর, শুয়োরের। যত্রতত্র পড়ে আছে আবর্জনার স্তূপ। এ ছাড়া গাড়ি রাখার বহর দেখে যে কারও গুলিয়ে যেতে পারে যে, এটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চত্বর না গাড়ির স্ট্যান্ড!
টুকরো টুকরো এই দৃশ্যগুলি ছাতনা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। বাঁকুড়ার এই ব্লকের অধীন ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় দু’লক্ষ মানুষের অন্যতম ভরসাস্থল এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অথচ সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামোর দেখা এখানে মেলে না বলে রোগীদের অভিযোগ। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুরুষ, মহিলা ও গর্ভবতীদের জন্য তিনটি ওয়ার্ড রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে সদ্যোজাতদের জন্য একটি ওয়ার্ড। পুরুষ ও মহিলা বিভাগে রয়েছে ১২টি করে বেড। গর্ভবতীদের ওয়ার্ডে আছে ছ’টি এবং সদ্যোজাতদের ওয়ার্ডে দু’টি বেড রয়েছে। হাসপাতালের ছাদ করোগেটেড টিনের ছাউনির। গ্রীষ্ম প্রধান এই জেলায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভিতরে গরমে হাঁফিয়ে মরেন রোগীরা। মৃত্যুঞ্জয় বাগদি, সীমান্ত ঘোষালদের মতো এলাকার বাসিন্দার ক্ষোভ, “আউটডোর খুবই ছোট। কিন্তু ভিড় মারাত্মক হয়। এখানে আসা মানে সারা দিনের জন্য নাকাল হওয়া। ভিড়ের চাপে রোগীদের অবস্থা আরও খারাপ হয়।”
হাসপাতাল চত্বরের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর বলেও তাঁরা জানিয়েছেন। তাঁদের কথায়, “হাসপাতালে সীমানা পাঁচিল বলে কিছু নেই। তাই, গরু, শুয়োর, কুকুরের অবাধ চরে বেড়ায় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে। যেখানে সেখানে আবর্জনা পড়ে থাকে।” গোটা হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার ভার এক জন মাত্র সাফাইকর্মীর হাতে। এর ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।
ওয়ার্ডের ভিতরে বেডের অভাবে মেঝেয় শুয়ে থাকতে হয় রোগীদের। এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন ছাতনার বামুনকুলি গ্রামের বাসিন্দা হেলি মুর্মু। বললেন, “কিছুদিন আগে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমার এক আত্মীয়কে ভর্তি করিয়েছিলাম। কোনও বেড মেলেনি। মেঝেতেই শুয়ে থাকতে হয়েছে। তুমুল বৃষ্টিতে পোকামাকড়ের উপদ্রবে আমার অসুস্থ আত্মীয় তো বটেই, আমরাও টিকতে পারিনি।” ওই গ্রামেরই কৃষ্ণ চক্রবর্তী সাফ বলে দিচ্ছেন, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে ন্যূনতম পরিকাঠামো থাকা দরকার, তা-ও এখানে নেই। অনেক ছোটখাট সমস্যাতেও বাঁকুড়া মেডিক্যালে রোগীকে রেফার করে দেওয়াটাই এই হাসপাতালের রেওয়াজ।” এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ, অনেক সময়েই প্রসব বেদনা নিয়ে কোনও অন্তঃসত্ত্বাকে নিয়ে এলে চিকিৎসকেরা বলে দেন, ‘এখানে ‘সেট-আপ’ নেই! বাঁকুড়া মেডিক্যালে নিয়ে যান’। ছাতনা থেকে মেডিক্যালে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। ওই সব বন্দোবস্ত করতে করতে অনেক সময় লাগে। ততক্ষণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন অন্তঃসত্ত্বা। “আর কত দিন সেট-আপ নেই, এই কথাটা শুনব বলতে পারেন?”ক্ষোভের সঙ্গে বললেন মৃত্যুঞ্জয়বাবুরা।
সমস্যা আরও আছে। বিদ্যুৎ সংযোগের তার ‘লুজ’ থাকায় প্রায়ই লোডশেডিং হয় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ছাতনার বিধায়ক শুভাশিস বটব্যালের বিধায়ক তহবিলের টাকায় হাসপাতালের জন্য একটি ইনভার্টার কেনা হয়েছে। সম্প্রতি সেটিও খারাপ হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একটি জেনারেটর থাকলেও তেলের খরচের টাকা না থাকায় তা ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। লোডশেডিং হলেই গোটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ডুবে যেত অন্ধকারে। তবে সদ্য জেনারেটরের তেল খরচের দায় আগামী দু’মাসের জন্য নিজের কাঁধে নিয়েছে পঞ্চায়েত সমিতি। সাময়িক ভাবে তাতে লোডশেডিংয়ের সমস্যা মিটলেও ভবিষ্যতে আঁধার কাটবে কি না তা বলা মুশকিল।
প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাও অপ্রতুল। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ছাতনা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঁচ জন স্থায়ী ডাক্তার থাকার কথা। সেখানে ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক বা বিএমওএইচ-সহ দু’জন স্থায়ী চিকিৎসক রয়েছেন। এ ছাড়া আরও দু’জন অস্থায়ী ডাক্তার আছেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে। সেটি খুবই পুরনো। লজঝড়ে ওই অ্যাম্বুলেন্স প্রায়ই খারাপ হয়ে যায়। মাঝে বিধায়ক তহবিলের টাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি সারানো হয়েছিল। কিন্তু, সম্প্রতি ফের সেটি বিকল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় বাইরে থেকে বেশি টাকা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়ি ভাড়া করে রোগীদের বাঁকুড়া নিয়ে যেতে হয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রান্নাঘরটি একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। বিধায়ক তহবিলের টাকায় বর্তমানে সেটি অবশ্য নতুন রূপ লাভ করেছে।
কিন্তু, রোগীদের পরিষেবার মানের বিশেষ একটা উন্নতি হয়নি বলেই অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। ছাতনার বিজেপি নেতা জীবন চক্রবর্তীর ক্ষোভ, “নতুন রাজ্য সরকারের উপরে অনেকেই আস্থা রেখেছিলেন। স্বাস্থ্য দফতর যেখানে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে, সেখানে মানুষ উন্নয়নের আশা করবেই। কিন্তু, ছাতনা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এলে সেই ধারণা ভেঙে যেতে বাধ্য।” ছাতনার ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক শচীন্দ্রনাথ রজক বলেন, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নানান সমস্যা রয়েছে। আমাদের সাধ্য অনুযায়ী মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।” ব্লকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা অবশ্য দ্রুত কাটবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন বিধায়ক শুভাশিসবাবু। তিনি জানান, ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে গড়ে উঠতে চলেছে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। হাসপাতাল গড়ার কাজও শুরু হয়েছে। আগামী দেড় বছরের মধ্যেই পুরোদমে সেই হাসপাতাল চালু হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।