এ কোন শান্তিনিকেতন, আক্ষেপ নিয়ে ফিরলেন ছাত্রী

অভিযোগ, দিনের পর দিন তিন সহপাঠী শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে, ব্ল্যাকমেল করেছে ভিন রাজ্যের ছাত্রীটিকে। তখন সুরক্ষা দেওয়ার চাড় দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে। শুক্রবার শান্তিনিকেতন ছাড়ার সময়ে অবশ্য নিরাপত্তারক্ষীদের কড়া পাহারায় ওই ছাত্রী আর তাঁর বাবাকে পৌঁছে দেওয়া হল স্টেশনে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছাত্রীর বাবা বললেন, “আমার মেয়ে পড়তে চেয়েছিল। আমরাও চেয়েছিলাম। কিন্তু এ কোন কলাভবন? এ কোন শান্তিনিকেতন?”

Advertisement

মহেন্দ্র জেনা

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪১
Share:

বাবার সঙ্গে বাড়ির পথে ছাত্রী। বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।

অভিযোগ, দিনের পর দিন তিন সহপাঠী শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে, ব্ল্যাকমেল করেছে ভিন রাজ্যের ছাত্রীটিকে। তখন সুরক্ষা দেওয়ার চাড় দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে। শুক্রবার শান্তিনিকেতন ছাড়ার সময়ে অবশ্য নিরাপত্তারক্ষীদের কড়া পাহারায় ওই ছাত্রী আর তাঁর বাবাকে পৌঁছে দেওয়া হল স্টেশনে।

Advertisement

স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছাত্রীর বাবা বললেন, “আমার মেয়ে পড়তে চেয়েছিল। আমরাও চেয়েছিলাম। কিন্তু এ কোন কলাভবন? এ কোন শান্তিনিকেতন?”

কলাভবনের প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রী তাঁর সিনিয়র তিন সহপাঠীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় প্রধান এবং অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, ওই তিন জন তাঁকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করেছে। মোবাইলে সেই ছবি তুলে রেখেছে। ব্ল্যাকমেল করে টাকাও আদায় করেছে। এমন গুরুতর অভিযোগ পাওয়ার দু’দিন পরেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পুলিশকে জানাননি বলে অভিযোগ। উল্টে অভিযুক্ত তিন ছাত্রকে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বলা হয়েছে বলেও দাবি।

Advertisement

এ দিন দুপুরে কলাভবনে শিক্ষক ও আধিকারিকদের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলার পর নিগৃহীত ছাত্রীর বাবা সাংবাদিকদের বলেন, “আমার মেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাব।” বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় তিনি যে ‘হতাশ’, সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “উপাচার্য এবং কলাভবনের অধ্যক্ষ বলেছেন, মিডিয়া-পুলিশের কাছে গিয়ে কী হবে? আপনাদের যদি জামাকাপড়-তোয়ালে লাগে, তা হলে আমরা দেব। আমি সত্যি সত্যি ভীষণ হতাশ, বিশ্বাস করুন।”

এ দিন মেয়েকে নিয়ে বাবা যতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন, বাবাকে নিয়ে মেয়েও ততটাই। এ দিনের বৈঠকে বিশ্বভারতীর তরফে ছিলেন কলাভবনের অধ্যক্ষ শিশির সাহানা, প্রোভস্ট তপতী মুখোপাধ্যায়, বিশাখা কমিটির সভাপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য। অন্য দিকে নির্যাতিতা ছাত্রী, তার বাবা এবং ছাত্রীর দুই বন্ধু ছিলেন। বৈঠক চলাকালীন ওই ছাত্রীকে বাইরে এসে ফোনে বলতে শোনা যায়, “বাবার উপর খুব চাপ দিচ্ছে ওরা।”

তৃণমূল সাংসদ তথা বিশ্বভারতীর সমাজকর্ম বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অনুপম হাজরা এ দিন কথা বলেন ওই ছাত্রীর বাবার সঙ্গে। তার পরে সাংসদ বলেন, “চূড়ান্ত নির্লজ্জতার পরিচয় দিল বিশ্বভারতী। যেখানে উচিত ছিল অভিযুক্ত ছাত্রদের শাস্তির ব্যবস্থা করা, সেখানে কার্যত ভয় দেখিয়ে, টাকার লোভ দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দিল।” তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ যোগেন চৌধুরী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “কী ঘটেছে, জানি না। তবে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা হচ্ছে, এ-ও কি সম্ভব?”

তিন সহপাঠী লাগাতার যৌন নিগ্রহ চালাচ্ছে, এমন অভিযোগ পেয়েও কেন পুলিশে খবর দেননি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ? কলাভবনের অধ্যক্ষ শিশির সাহানা বলেন, “আমি পুলিশে জানাতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমি কি ওর বাবা, নাকি ও আমার সন্তান, যে পুলিশে অভিযোগ জানাব?”

উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত বলেন, “ঘটনাটি আমার নজরে এসেছে বৃহস্পতিবার রাতে। তারপরেই শিশিরবাবু এবং মৌসুমীদেবীকে ডেকে আমি কথা বলি। বিশাখা গাইডলাইন অনুসারে দ্রুত তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিই।” পুলিশে কেন গোটা বিষয়টি জানানো হয়নি? উপাচার্যের উত্তর, “আমি অভিভাবক নই। মেয়ের বাবাই পুলিশের কাছে যেতে পারেন।” পুলিশের কাছে যাওয়ার পরামর্শ কি আপনি ওই ছাত্রী বা তাঁর বাবাকে দিয়েছেন? “আমি বলেছি, তাঁরা পুলিশের কাছে যেতে পারেন। বিশ্বভারতীর তরফে আমরা বলতে পারি, দ্রুত তদন্ত শেষ করা হবে। হয়তো তদন্তের পর আমরাই পুলিশের কাছে যাব।”

এ ব্যাপারে কী বলছে কেন্দ্রীয় মানব উন্নয়ন মন্ত্রক? মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি বিষয়টিকে একেবারেই হালকা করে দেখার পক্ষপাতী নন। এ দিন নির্যাতিতা ছাত্রীর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “বিষয়টি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভাবে না জেনে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে যৌন নিগ্রহের লিখিত অভিযোগ পেয়েও যদি তা পুলিশে জানানো না হয়ে থাকে, তা মেনে নেওয়া হবে না।” মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “যৌন নির্যাতন ফৌজদারি অপরাধ। তেমন কোনও ঘটনা ঘটলে আক্রান্ত ছাত্রীর যেমন পুলিশে জানানো উচিত, তেমনই সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও একই রকম দায়িত্ব থাকে পুলিশকে জানানোর। না হলে আইনের ধারা অনুযায়ী অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য গোপন করা হয়েছে বলে ধরা হতে পারে।”

শুক্রবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বীরভূম পুলিশ সুপারের কাছে ঘটনাটি নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছে রাজ্য মহিলা কমিশন। কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “বিশ্বভারতীর শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিকে বলা হয়েছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই তিন অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে।” তা ছাড়াও যৌন নিগ্রহের মতো ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে আইন অনুযায়ী ওই তিন ছাত্রকে বহিষ্কার বা সাসপেন্ড করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরই ছাড়া হয়েছে। পুলিশ সুপার এবং বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে আগামী সোমবারের মধ্যে রিপোর্ট মহিলা কমিশনের কাছে রিপোর্ট দিতে হবে। মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য ভারতীদেবী বলেন, “ব্যাপারটাকে লঘু করে দেখার চেষ্টা চলছে। পরিবর্তিত আইনে যৌন নির্যাতন অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। পুলিশি তদন্তের ব্যবস্থা অবশ্যই করা উচিত।”

নির্যাতিতা ছাত্রী কি এর পরে শান্তিনিকেতনে ফিরবেন? স্টেশনে দাঁড়িয়ে তাঁর বাবা বলেন, “অভিযোগ প্রত্যাহার করছি না। দু’তিন দিনের জন্য মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ওর মানসিক অবস্থা ঠিক হলে ফিরব।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement