অঙ্কন: সুমিত্র বসাক।
কান টানলে মাথা আসে— সবাই জানে। কান টানায় প্রাণও বাঁচে— হলফ করে বলতে পারেন বিন্দু মুড়া। পুরুলিয়ার কোটশিলার এই বধূ জঙ্গলে ভালুকের মুখে পড়ে ঘাবড়ে যাননি। কষে তার কান মলে দিয়েছেন। তাতে থাবার ঘা খেতে হয়েছে। তবে প্রাণ বেঁচেছে। বাঁ উরুতে ক্ষত নিয়ে বছর চুয়াল্লিশের বধূটি এখন পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
কোটশিলার কাঁড়িয়র গ্রামে বাড়ি বিন্দুদেবীর। স্বামী বুধু মুড়া প্রান্তিক চাষি। দম্পতির পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে। স্বামীর সঙ্গে শনিবার জঙ্গল লাগোয়া ধান-জমিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন বধূটি। জমির কাজ শেষে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে তাঁরা জঙ্গলে ঢোকেন। হামলা হয় তখনই।
ঝোপে ঘাপটি মেরে ছিল ভালুক। আচমকা তেড়ে আসে বিন্দুদেবীর দিকে। বিন্দুদেবীর কথায়, ‘‘ভালুকটা ডান পায়ে থাবা মারতে যায়। পা সরিয়ে নিই। বড় জা-য়ের কাছে শুনেছিলাম, কান চেপে ধরলে ভালুক কিছুটা দমে যায়। সেটাই প্রাণে বাঁচার সুযোগ। গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে তাই ওর কান চেপে ধরেছিলাম।’’
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিন্দুদেবীর বড় জা কমলা মুড়াও জঙ্গলে ভালুকের মুখোমুখি পড়েছিলেন। এবং তাঁর দাবি, ‘কান মলা’র কৌশল নিয়েই প্রাণে বেঁচেছিলেন। কমলাদেবী গায়ের জোরে ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি ভালুককে। কান ছাড়িয়ে সে নখের আঁচড় মারে, কামড়ে দেয় বধূটিকে। ভাগ্য ভাল থাকায় সে যাত্রা প্রাণে বাঁচেন কমলাদেবী। ছোট জা বিন্দুকে সে গল্প অনেকবার শুনিয়েছেন তিনি।
বিন্দুর প্রাণ বাঁচানোয় অবশ্য ভূমিকা আছে তাঁর স্বামী বুধুরও। স্ত্রী একটা ধুমসো ভালুকের সঙ্গে যুঝছে দেখে এক মুহূর্ত দেরি না করে হাতের সামনে পড়ে থাকা বড় পাথরের চাঁই তুলে তিনি ছুড়ে দেন ভালুকের দিকে। ততক্ষণে বিন্দুর শরীরের বাঁ দিকে থাবা বসিয়েছে ভালুক। তবে পাথর গায়ে লাগতেই তড়বড়িয়ে জঙ্গলের গভীরে গা ঢাকা দেয় সে। বুধু বলেন, ‘‘কাঠ জোগাড় করতে গিয়ে খসে পড়া ডাল খুঁজছিলাম বলে কুড়ুল হাতে রাখিনি। সঙ্গের কুড়ুল রাখা ছিল দূরে গাছের গোড়ায়। কুড়ুল থাকলে সেটা নিয়েই ভিড়ে যেতাম।’’
বন দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার জঙ্গলে সাধারণত ‘এশিয়াটিক ব্ল্যাক বেয়ার’ দেখা যায়। কোটশিলা ও ঝালদার জঙ্গলে কিছু ‘স্লথ বেয়ার’ও রয়েছে। অনেক সময় বিনা প্ররোচনায় মানুষের উপরে হামলা করে ভালুক। বিশেষ করে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে ভালুকের উৎপাত একেবারেই নতুন নয়। গত বছর পাঁচেকে দক্ষিণবঙ্গে অন্তত ১১-১২টি ভালুকের হামলার ঘটনা জানা রয়েছে বন দফতরের। তেমন একটি হামলায় পুরুলিয়াতেই চোখ নষ্ট হয়েছে এক বনকর্মীর। ভালুকের হামলার খবর শোনা যায় উত্তরবঙ্গেও।
ঘটনা জেনে বিন্দুদেবীকে হাসপাতালে ভর্তি করায় বন দফতর। চিকিৎসার খরচও বইছে তারা। ডিএফও (পুরুলিয়া) কুমার বিমল বলেন, ‘‘মাথা ঠান্ডা রেখে ভালুকের সঙ্গে লড়ে সাংঘাতিক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন বিন্দুদেবী।’’
লড়াইটা মনে পড়লেই এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বিন্দুদেবী বলছেন, ‘‘ভাগ্যিস, হাতের নাগালে ওর কান দু’টো পেয়ে গিয়েছিলাম!’’