বৃষ্টি যদি আর কিছুক্ষণ চলত, তাহলে কী হত— একটা দিন পার করেও সেই আতঙ্ক তাড়া করছে হড়পা বানে ফুঁসে ওঠা বামনি ঝোরার মাঝে পাথরে আটকে পড়া তরুণের। বৃহস্পতিবার বিকেলে পুলিশ কর্মীরা রীতিমতো ঝুঁকি নিয়ে আড়শা থানার বাসিন্দা ওই তরুণ ও তাঁর বান্ধবীকে উদ্ধার করে আনেন। কিন্তু শুক্রবারও মন থেকে আতঙ্কের ছাপ মোছেনি।
তিন বন্ধু ও দুই বান্ধবী মিলে আযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে মৃত্যুর মুখে যে তাঁদের পড়তে হবে ভাবেননি। ঘোরের মধ্যে ওই তরুণ বলছিলেন, ‘‘বামনি ঝোরার ওই পাথরে অনেকেই ওঠে। আমরা পাঁচ জনে বসেছিলাম। অল্প বৃষ্টিতে প্রকৃতি উপভোগ করছিলাম। বৃষ্টির কারণে ঝোরার জল অল্প অল্প বাড়ছিল। তাই আমরা সেখান থেকে উপরে ওঠার জন্য উঠে পড়ি। তিন জন ঝোরা পার হয়ে গেল। বাকি দু’জন পার হতে যাব, সেই সময় হঠাৎ দেখি তীব্র বেগে উপর থেকে জল আছড়ে পড়তে শুরু করল। ভয়ে আমরা পিছিয়ে যাই। ব্যাস, মুহূর্তে জলস্তর বাড়তে শুরু করে দিল। আমরা আটকা পড়ে গেলাম।’’
ধীরে ধীরে শান্ত বামনি ঝোরা ফুঁসে উঠতে শুরু করে। একশো ফুট উঁচু থেকে ঝর্নার জল পড়ে পাথরের চার পাশ দিয়ে আরও নীচে নামতে থাকে। ওই তরুণের কথায়, ‘‘পাহাড়ের ছেলে হলেও হড়পা বান এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা কখনও দেখিনি। জল ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছিল। ঝোরার জল চার পাশে আছড়ে পড়ছিল। সেই শব্দে কান যেন ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। দেহ যেন অসাড় হয়ে পড়েছিল। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ঝোরার জল আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল।’’
ঝোরা থেকে উঠে আসা তিন বন্ধু তখন অসহায়ের মত সাহায্য করার জন্য লোকজন খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্য বলরামপুরের এক তরুণ বলেন, ‘‘উপরে ওঠার পরে খেয়াল করি, বাকি দু’জন নেই। খোঁজ করতে নেমে দেখি, ঝোরা থেকে তীব্র বেগে জল আছড়ে পড়ছে। আর মাঝখানের বড় পাথরটায় ওঁরা দু’জনে আটকে পড়েছে। আমাদের দেখতে পেয়ে তাঁরা হাত নেড়ে উদ্ধারের জন্য ইশারা করছিল। কিন্তু আমরাও অসহায়। মাথা কাজ করছিল না।’’
তাঁরা দুই এলাকাবাসীকে সব জানান। তাঁদেরই কেউ পুলিশে খবর দেন। কিছু করতে না পেরে সবাই যখন হাত কামড়াচ্ছিলেন, সেই সময়েই পুলিশ সেখানে পৌঁছয়। উদ্ধারকারী দলের বাঘমুণ্ডি থানার এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘বৃষ্টি ধরে এলেও ঝোরার জলের বেগ কমেনি। ঝোরার এক পাশ থেকে ওই পাথরের দূরত্ব কমবেশি চল্লিশ ফুট। সেখান দিয়ে তীব্র বেগে জল আরও প্রায় ১০০ ফুট নিচে নামছিল। পা পিছলে গেলে শরীরের কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। এ দিকে ছেলেমেয়ে দু’টি বৃষ্টিতে ভিজে, আতঙ্কে যেন নেতিয়ে পড়েছিল। চিৎকার করে, হাত নেড়ে তাঁদের সাহস দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা।’’
এরপরে তাঁরা দুই পাড়ের গাছে পাঁচ গাছা দড়ি বেঁধে ওই পাথরের দিকে এগিয়ে যান। শক্ত হাতে দু’জনকে ধরে এ পাড়ে নিয়ে আসেন তাঁরা। আটকে পড়া তরুণের এক এক বন্ধুর কথায়, ‘‘আতঙ্ক যেন আমাদেরও তাড়া করছে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি, নীচ দিয়ে তীব্র বেগে বইছে জল। ঝুলন্ত অবস্থা ওঁদের উদ্ধার করে আনা হচ্ছে। ভয়ে বুকটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।’’ আটকে পড়া ওই তরুণ বলেন, ‘‘পুলিশ কর্মী থেকে সিভিক ভলান্টিয়ার, গ্রামীণ পুলিশ যে ভাবে নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাঁচালেন, তাতে ধন্যবাদ শব্দটাও খুব কমজোরি মনে হচ্ছে।’’
পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বলেন, ‘‘খুব ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ কর্মী-সহ অন্যেরা দু’জনকে উদ্ধার করেছেন। ওঁদের সাহসিকতার প্রশংসা করতে হয়।’’ তবে বামনি ঝোরায় যাওয়া পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়েও এ বার প্রশাসন নড়েচড়ে বসছে। জেলাশাসক বলেন, ‘‘পুলিশ ও বন দফতরকে নিয়ে বৈঠক করা হবে। বামনি ঝোরার নীচের দিকে নামার জন্য রেলিং লাগানো যায় কি না দেখা হবে। আর কোন কোন জায়গা বিপজ্জনক, তা বোর্ডে লিখে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’’