গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কারও জন্য কি কিছু থেমে থাকে! অনুব্রত মণ্ডল তাঁর ‘গড়ে’ ফিরলেও আবার তাঁকে পুরনো মেজাজেই দেখা যাবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। দীর্ঘ কারাবাসের পর মঙ্গলবার অনুব্রত বোলপুরে ফেরার পর জেলা তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেরও আভাস মিলেছে। বুধবার সেই ‘তত্ত্ব’ই আরও চওড়া হল যখন বোলপুর তৃণমূল কার্যালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হল কোর কমিটির নেতাদের ছবি। জেলার নেতাদের সরিয়ে শুধু কেষ্টর ছবি ঠাঁই পেল কার্যালয়ের দেওয়ালে। যা নিয়ে তৃণমূলের জেলা কোর কমিটির সদস্য তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ কার্যত ক্ষুব্ধ। তিনি সাফ জানিয়েছেন, কাজটি মোটেই ঠিক হয়নি। কাজল বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বীরভূমের দু’টি আসন জিতিয়েছে কোর কমিটি-ই। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি। তাই কোর কমিটির সদস্যদের ছবি সরিয়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি।’’
বুধবার সকাল থেকে বোলপুর তৃণমূল কার্যালয়ের দরজা, গ্রিলে রং শুরু হয়। অনুব্রতকে অভিবাদন জানাতে সেজে ওঠে দলীয় অফিস। একে একে অভিজিৎ সিংহ, চন্দ্রনাথ সিংহ, বিকাশ রায়চৌধুরী, সুদীপ্ত ঘোষ, আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়। তার পর কেষ্টর ৯টি ছবি কার্যালয়ের ভিতরে টাঙানো হয় বলে তৃণমূলেরই একটি সূত্রে খবর। গেটের সামনেও রয়েছে অনুব্রতের বড় কাটআউট। জেলযাত্রার পর কি ‘লালমাটির দেশে’ আধিপত্য খুইয়ে বসেছেন অনুব্রত? তাই কি ঘরে ফিরেই ‘গড়রক্ষায়’ এত তড়িঘড়ি, এত ব্যস্ততা? জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বলছেন, ও সব কিছুই না। তাঁরা এক হয়ে কাজ করছেন। বিকেলে তৃণমূল কার্যালয়ে অনুব্রত বৈঠক করেন জেলার দলীয় বিধায়ক এবং নেতৃত্বের সঙ্গে। সেই বৈঠক শেষে নেতারা জানাচ্ছেন, আগের ফর্মে দেখা যাবে কেষ্টকে। বৈঠকে অনুব্রত নাকি জোর দিয়ে সংগঠন করতে বলেছেন সবাইকে।
কিন্তু জেলা তৃণমূলে সব কিছুই যে সুরে বাজছে না, তার আভাস মিলছে নেতাদের স্বল্প কথাবার্তায়। মঙ্গলবার কেষ্টর বাড়িতে গেলেও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহদের। বুধবার অবশ্য অনুব্রতের বৈঠকে তিনি জেলা কার্যালয়ে ছিলেন। বৈঠকে কী আলোচনা হল, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি কেউই। প্রায় দু’বছর পর দলীয় কার্যালয়ে কেষ্ট ঢোকার পর সেখানে গিয়েছিলেন বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ, সিউড়ির বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী, সাংসদ অসিত মাল-সহ অন্যান্য নেতা। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তাঁদের বেশি চিন্তিত দেখাল অনুব্রতের স্বাস্থ্য নিয়ে। কার্যালয়ে ঢোকার আগে অনুব্রত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। নিরাপত্তারক্ষীদের কাঁধে ভর দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে লিফ্টে দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি জানান, তাঁর পায়ের ‘অবস্থা ভাল নয়’। দলের নেতারাও বলছেন, ‘‘দাদার পায়ের সমস্যাটা বেড়েছে।’’
অন্য দিকে, কাজল এবং অনুব্রতের ‘সুসম্পর্ক’ সুবিদিত। অনুব্রত বীরভূমে তৃণমূল জেলা সভাপতি থাকাকালীন কাজলকে দলে ‘কোণঠাসা’ হয়ে থাকতে হয়েছিল। দু’পক্ষের অন্তর্বিরোধও বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কাজলের অন্তর্ঘাতের জন্যেই নানুরে জেতা আসনে সিপিএমের কাছে অনুব্রতের ‘স্নেহধন্য’ গদাধর হাজরাকে হারতে হয় বলে তৃণমূলের অনেকের দাবি। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নানুর এলাকায় কাজলকে ভোটের দায়িত্ব দেন অনুব্রত। কাজল সেই নির্বাচনে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের আওতাধীন ৭টি বিধানসভার মধ্যে নানুরে দলকে সর্বোচ্চ লিডও দেন। তার পরে কাজল ব্লক কার্যকরী সভাপতির পদ পান। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে নানুর ‘পুনরুদ্ধার’ করে কাজল আবার তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করেন। তার পর গরু পাচার মামলায় অনুব্রত জেলে যাওয়ার পরে দলে কাজলের গুরুত্ব বাড়ে। তাঁর অনুগামীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠেন জেলার রাজনীতিতে। বীরভূমে জেলা সফরে এসে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাজলকে জেলা কোর কমিটির সদস্য করে দিয়ে যান। নানুর এলাকা থেকে প্রথম নির্বাচনে জিতে জেলা সভাধিপতি মনোনীতও হন তিনি।
দলনেত্রী মমতা গত লোকসভা নির্বাচনে কাজলকে নানুর এবং কেতুগ্রাম বিধানসভা এলাকা দেখার দায়িত্ব দেন। তৃণমূল সূত্রে দাবি, সেই থেকে ওই দু’টি কেন্দ্র, বিশেষ করে নানুরে রেকর্ড সংখ্যক লিড দেওয়াটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় কাজলের কাছে। সেটা তিনি করেও দেখান। কিন্তু মঙ্গলবার নেতা-মন্ত্রীরা কেষ্টর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে গেলেও সেই চৌহদ্দিতে দেখা যায়নি কাজলকে। তিনি অবশ্য দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফর ছিল। সে জন্য সময় বার করে উঠতে পারেননি। কাজলের কথায়, ‘‘বীরভূমের ন’টি অঞ্চল বন্যাবিধ্বস্ত। জেলার সভাধিপতি হিসাবে আমার দায়িত্ব আছে। মুখ্যমন্ত্রী রিপোর্ট নিতে এসেছিলেন। আর দাদার বাড়ি ভাই যাবে, তাতে দিনক্ষণ, সময় জানানোর কী আছে!’’
বোলপুর তৃণমূল কার্যালয়ে ছবি-কাণ্ড এবং দ্বন্দ্বের আবহ নিয়ে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ দাবি করেছেন, সবই ঠিক আছে। তিনি বলেন, ‘‘২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বীরভূমের দু’টি আসনেই তৃণমূল জিতেছে। বীরভূমে তৃণমূলের সংগঠন ভাঙার অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বিরোধীরা সুবিধা করতে পারেনি।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘দল সাংগঠনিক বিষয়টি দেখছে। পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রয়েছে শীর্ষ নেতৃত্বের।’’