আলোয় সেজেছে কীর্ণাহার শিবচন্দ্র হাইস্কুল। ছবি: কল্যাণ আচার্য।
একটা অনুচ্ছেদের ইংরেজি অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন স্যর। একবার দেখানোর পরে জানালেন, ঠিকই হয়েছে। তবে আরও ভাল লেখা যায়। এ ভাবে সাতবার লেখানোর পরে দেখে স্যর বললেন, এ বার ঠিক হয়েছে। তাহলে কত নম্বর পাওয়া যাবে এমন লিখলে? এই প্রশ্নের উত্তরে স্যরের উত্তর, পনেরোর মধ্যে সাত থেকে সাড়ে সাত।
বাংলা স্যরের পড়ানোর টাইমিংটা ছিল অসাধারণ। স্কুল পাঠ্য কবিতা ‘আশ্বিনের ঝড়’ পড়িয়েছিলেন আশ্বিন মাসে একটা ঝড়ের পরে। কবিতাটা যেন প্রকৃতির মধ্যেই ফুটে উঠেছিল।
‘‘এতো দু’টো উদাহরণ। কীর্ণাহার শিবচন্দ্র হাইস্কুলের শিক্ষকদের পড়ানোর কথা লিখতে গেলে শেষ হবে না’’, বলছিলেন কীর্ণাহার হাইস্কুলের প্রাক্তনীরা। আজ, বুধবার ১ জানুয়ারি শুরু হয়ে তিন দিন ধরে হবে স্কুলের একশো পঁচিশ তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান। প্রাক্তনীরা জানালেন, বীরভূম জেলার অজস্র মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো দেখিয়েছিল এই স্কুল। এই স্কুল সময়ের থেকে বরাবরই অনেকটা এগিয়ে বলেও জানালেন তাঁরা।
কীর্ণাহারের জমিদার শিবচন্দ্র সরকারও বরাবরই পড়াশোনার অনুরাগী ছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর সাতের দশকে শিবচন্দ্র সরকার প্রথমে তাঁদের এলাকায় একটি মেয়েদের স্কুল স্থাপন করার পরিকল্পনা করেন। স্কুলটা শুরুও হয়েছিল। স্কুলের বর্তমান শিক্ষকদের মতে, জমিদার শিবচন্দ্র সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন তা এ থেকেই বোঝা যায়। তবে কিছুদিন চলার পরে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়।
স্কুলেরই প্রাক্তনী, কবি ও প্রাবন্ধিক নাসিম এ আলম জানাচ্ছেন, শিবচন্দ্র মেয়েদের জন্য একটি বইও লেখেন। বইয়ের নাম ছিল ‘পল্লীপাঠিকা’। ওই বইয়ের ভূমিকা লেখেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি বাড়িতে সাহিত্যের আসরও বসাতেন। তিনি ছেলেদের জন্যও একটি স্কুল চালু করার পরিকল্পনা করেন। ১৮৮৫ সালে মাত্র উনপঞ্চাশ বছর বয়সে শিবচন্দ্রের মৃত্যু হয়। পরে তাঁর ছেলেরা বাবার সাধ পূরণ করার জন্য বাবার স্মৃতিতে ১৮৯৫ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাক্তন শিক্ষকেরা জানালেন, স্কুলের ভবন তৈরি করার জন্য কীর্ণাহার ও তার সংলগ্ন গ্রাম, যেমন নিমড়া, পরোটা, সরডাঙার গ্রামের মানুষেরা ইট বয়ে এনেছেন। স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়ের সময় স্কুলের নানা অগ্রগতি হতে শুরু করে। মরুতীর্থ হিংলাজ, উদ্ধারনপুর ঘাটের লেখক অবধূত কীর্ণাহারের কাছে মুণ্ডমালিনীতলায় আশ্রমে ছিলেন কয়েক বছর। তখন রামশম্ভুবাবুর সঙ্গে অবধূতের ঘনিষ্টতা বাড়ে। অবধূত ও রামশম্ভুবাবু খেতে গিয়ে চাষিদের কাছে বস্তা বস্তা ধান কিনে আনতেন। সেই ধান বিক্রির টাকা স্কুলের উন্নতিতে দেওয়া হত।
স্বাধীনতার আগে স্কুলটি ইংরেজি মিডিয়াম। নাম ছিল কীর্ণাহার শিবচন্দ্র হাই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র তথা ওই স্কুলেরই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নবকুমার মিশ্র বলেন, ‘‘আমরা স্যরদের কাছে যতটা শিখতে পেরেছি, তার কতটুকুই বা দিতে পেরেছি? স্যররা যা পড়াতেন তা মনের ভিতরে একেবারে গেঁথে যেত।’’ নবকুমারবাবু ষাটের দশকের শেষ ও সত্তর দশকের প্রথমে শিবচন্দ্র স্কুলে পড়েন। তখন দেখেছেন কেউ স্কুলে কয়েকদিন না এলে স্যরেরা হেঁটে হেঁটে গ্রামে পৌঁছে যেতেন ছাত্রদের বাড়িতে।
স্কুলের শিক্ষকরা জানালেন, শুধু প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ই এই স্কুলের উজ্জ্বল ছাত্র নন, কৃতীদের তালিকা তৈরি করতে হলে তা অনেক বড় হয়ে যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই স্কুলের প্রাক্তনীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তবে এত প্রাক্তনীদের মধ্যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণববাবুর কথা আলাদা করে উল্লেখ করেন সবাই। শিক্ষকেরা জানান, প্রণববাবু পঞ্চম শ্রেণি থেকে পড়লেও তাঁর নাম হাজিরা খাতায় রয়েছে সপ্তম শ্রেণি থেকে।
স্কুলেরই আরেক প্রাক্তন ছাত্র, তথা প্রাক্তন শিক্ষক রণজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘তখন স্নাতকোত্তরে ভাল রেজাল্ট করার পরে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির আবেদন করছি। আমাদের স্কুলের প্রধানশিক্ষক আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন কোথাও যেতে হবে না। এখানেই পড়াতে শুরু দাও। এই স্কুলে পড়েছ একটু তার ঋণ শোধ কর।’’ রণজিৎবাবুর কথায়, ‘‘হে়ডস্যারের কথা কীভাবে অমান্য করি? সেই যে ওই স্কুলে শিক্ষকতা করতে ঢুকলাম তারপর অন্য শহরে লোভনীয় ভাল বেতনের চাকরি পেলেও আর অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি। সারা জীবন এই স্কুলেই শিক্ষকতা করেই কেটে গিয়েছে।’’
বরাবরই সময়ের থেকে এগিয়ে ছিল এই স্কুল। ষাটের দশকের শেষের দিকে আশপাশে যখন কোনও স্কুল ছিল না তখনই এই স্কুলে শুরু হয়ে গিয়েছিল স্কুলের পোশাক। খাকি প্যান্ট ও সাদা জামা ছিল স্কুল ড্রেস। এমনকি স্কুলে ছাত্রদের ব্যাজও তখন থেকে চালু হয়ে গিয়েছিল বলে জানালেন স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষকরা। শুধু পড়াশোনাই নয় খেলাধুলোর উন্নতির জন্য স্কুলের এবড়ো খেবড়ো মাঠ সমান করে তাতে ঘাসের বীজ পোঁতা হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল স্কুলের পাকা পাঁচিল। সেই সময়কার কোনও স্কুল ঘিরে এ রকম কর্মকাণ্ড বিরল ঘটনা। এ ভাবেই বরাবর এগিয়ে থেকেছে এই স্কুল।