প্রতীকী ছবি।
কলকাতায় বিড়লা গোষ্ঠীর দু’টি স্কুলে শিশুছাত্রীর যৌন নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভে তোলপাড় রাজ্য। এই প্রেক্ষাপটে উদ্বেগজনক তথ্য হল রাজ্যজুড়েই শিশুদের উপরে যৌন নিগ্রহের সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যানের পাতা ওল্টালে বীরভূমের ছবিটাও ভাল কিছু নয়।
২০১২ সালে ‘প্রিভেনশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস’ বা পকসো আইন চালু হয়। বীরভূমের সিউড়িতে বিশেষ আদালত চালু হয়েছে তার পরের বছর, ২০১৩ সালে। প্রতি বছর লাফ দিয়ে একের পর এক অভিযোগের সংখ্যা-বৃদ্ধি দেখে শিউরে উঠছেন বিচারকেরাই। বীরভূম জেলার আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বীরভূমের সিউড়িতে বিশেষ পকসো আদালত ছিল। জেলার শিশুদের যৌন নির্যাতনের বিচার হত সেখানেই। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে বোলপুর ও রামপুরহাট মহকুমায় দুটি পৃথক পকসো আদালত হয়েছে। তার মূল কারণ মামলার সংখ্যাবৃদ্ধি।
ঘটনা হল, ২০১৩ সালে সিউড়িতে যখন পকসো আদালত হয়, তখন মামলার সংখ্যা ছিল ১৩টি। ঠিক পরের বছরেই সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫। ২০১৫ সালে অপরাধের সংখ্যা ছিল ৭৯। ২০১৬ সালে আরও দুটি আদালত হয়ে গেলেও সংখ্যা ছিল ৭৬টি। এ বার রামপুরহাট এবং বোলপুর পকসো আদালত বাদ দিয়ে শুধু সিউড়িতেই পকসো আইনে মামলা হয়েছে ৫৩টি। অর্থাৎ জেলা জুড়ে সংখ্যাটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। আরও উদ্বেগের, শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতনে অভিযুক্তের তালিকায় থাকা একটা অংশই শিক্ষক।
শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতনে আইনি ব্যবস্থা নিতে পকসো আইনে অভিযোগের বহর থেকে স্পষ্ট, রোগের শিকড় অনেক গভীরে। রাঢ়বঙ্গের এই জেলায় ওই বিশেষ আইনে গত কয়েক বছরে জমে থাকা মামলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সদ্য বুলি ফোটা শিশু থেকে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে— বিকৃতমনষ্কদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউই।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্তারা বলছেন, ‘‘পরিসংখ্যান সামনে এলে বোঝা যায়, কী করুণ ভাবে বেঁচে রয়েছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। আরও এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলি সরকারি খাতায় ওঠেইনি। তা হলে সংখ্যাটা কোথায় যেত ভাবুন!’’ বীরভূমের শিশু সুরক্ষা আধিকারিক নিরুপম সিংহ বলছেন, “আমরা লক্ষ করেছি যে, শিশুরা বয়ষ্ক পুরুষের বিকৃত যৌন লালসার শিকার হচ্ছে। তবে ব্লক ও সংসদস্তরে যে শিশু সুরক্ষা কমিটিগুলি তৈরি হয়েছে, সেগুলিকে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। অভিভাবকদের ভালমন্দের মাঠ দেওয়ার ভাবনা-চিন্তাও রয়েছে। সেগুলি যথাযথ ভাবে কাজ করলে অপরাধের সংখ্যা কমবে।’’ নিরুপমবাবু আশ্বাস, ‘‘আমরা স্কুলগুলিতেও ধারাবাহিক প্রচার চালাব।’’
কিন্তু, বিকৃতিতে রাশ টানা গিয়েছে কি? জেলার বিশেষ পকসো আদালতের সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, “সাজা ঘোষণার হার বেড়েছে। যদিও শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতন থামেনি।’’ রনজিৎবাবু অন্য একটা আশঙ্কার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সবক্ষেত্রেই সব অভিযোগ ঠিক এমনটা নয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, শক্ত আইনকে হাতিয়ার করে অনেকে অন্যায় সুযোগও নিচ্ছে।’’
অপরাধ ঠেকানোর উপায় তা হলে কী?
কলকাতার মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বলছেন, ‘‘শুধুমাত্র শাস্তি দিয়ে এই ধরনের অপরাধ ঠেকানো যাবে না। কারণ, যাঁরা এ কাজ করছেন তাঁরা পেডোফিলিয়া নামক একটি মানসিক অসুখে ভুগছেন। তাঁরা চাইলেও বিকৃত-কাম থেকে নিজেদের আটকাতে পারছেন না। একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চিকিৎসা করালে তাঁরাও সুস্থ হয়ে উঠবেন। এ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারবেন। সেই প্রচারটাও চালাতে হবে।’’