বিষ্ণুপুর বিখ্যাত সাত বাঁধের অন্যতম এই যমুনাবাঁধ। প্রশাসনিক উদাসীনতা ও জমি মাফিয়াদের দাপটে বাঁধ হারিয়ে যাচ্ছে। কচুরিপানার জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বাঁধের জল। ছবিটি তুলেছেন শুভ্র মিত্র।
মল্ল রাজধানী বিষ্ণুপুরকে সুরক্ষিত রাখতে রাজবাড়িকে ঘিরে পরিখা গড়েছিলেন মল্লরাজারা। শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে শহরের সাতটি বাঁধের জল ছেড়ে দেওয়া হত সেই পরিখায়। গোলাবারুদ নিয়ে এগোতে পারত না শত্রুসেনারা। বর্গী আক্রমণের সময় সাফল্যও এসেছিল এই পদ্ধতিতে। কিন্তু বহুকালই হল সেই পরিখা বুজিয়ে বসতবাড়ি গজিয়ে উঠেছে এই প্রাচীন শহরে। আর যে সাতটি বাঁধের জল শুধু সুরক্ষার কাজেই লাগত না, তীব্র খরায় জল সমস্যার মোকাবিলা করত শহরবাসীর। সেই বাঁধগুলিও প্রশাসনিক উদাসীনতায় মজে যাচ্ছে ক্রমশ ক্রমশ।
আজ বুধবার, বিশ্ব জলাভূমি দিবস। আর সে জন্য আরও এক বার সামনে চলে আসছে বিষ্ণুপুরের সাত বাঁধের বেহাল দশার প্রসঙ্গ। শহরের পূর্ব প্রান্তে লালবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ ও শ্যামবাঁধ। পশ্চিম প্রান্তে যমুনাবাঁধ, কালিন্দীবাঁধ ও গাঁতাতবাঁধ। এই ছয় বাঁধের মাঝামাঝি অংশে শহরের জনবহুল এলাকা চকবাজারের পাশেই রয়েছে বীরবাঁধ। যার বর্তমান নাম পোকাবাঁধ।
কেমন অবস্থা বাঁধগুলির? জানার জন্য মঙ্গলবার কথা বলা হয়েছিল ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে। সকলেরই ক্ষোভ, “স্নানের জন্য এক সময় ব্যবহার হত এই বাঁধের জল। এখনও অনেকে স্নান করেন। কিন্তু, বাঁধ ক্রমশ মজে যাওয়ায়, পানায় ভর্তি হয়ে যাওয়ায়, জল কমে যাচ্ছে, দূষিত হয়ে পড়ছে। এই নিয়ে সরকারি কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।’’ বাঁধগুলি মজে গিয়ে জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মাটির নীচের জল সঞ্চয়ও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলেও অভিযোগ শহরবাসীর।
এখনও সারা দিনে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ স্নান সারেন যমুনাবাঁধে। বাঁধের পশ্চিম পাড়ে চলে গিয়েছে একটি মোরাম বিছানো রাস্তা। সেই রাস্তার বাঁ দিকে আলাদা করে রয়েছে ছেলেদের ও মেয়েদের বেশ কয়েকটি স্নানের ঘাট। কিন্তু সবই প্রায় পানায় ভর্তি। এ দিন ঘাটে স্নান করতে আসা সুদীপ দাস বললেন, “পানা হাত দিয়ে সরিয়ে বাধ্য হয়ে আমাদের ঘাটে নামতে হয়। এমন অপরিষ্কার অবস্থা আগে কখনও ছিল না।’’ একই দাবি সুমিতা পালের। তাঁর কথায়, “কয়েক বছর আগেও টলটলে জল ছিল এই বাঁধের। এখন নোংরা পানায় ভর্তি। তার মধ্যেই বাধ্য হচ্ছি স্নান সারতে। সংস্কার নিয়ে কেউ ভাবে না।’’
রাজনর্তকী লালবাঈয়ের নানা কাহিনি ছড়িয়ে আছে লালবাঁধকে ঘিরে। এলাকার বাসিন্দা ছাড়াও বিষ্ণুপুরে বছর ভর আসা বহু পর্যটকও স্নান সারেন এই বাঁধে। কিন্তু, সিমেন্টে বাঁধানো মূল ঘাটটিই পানায় ভর্তি। বাঁধের পিছনের বেশ কিছুটা অংশ মজে গিয়ে ধান জমিতে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা যমুনাবাঁধের পিছনের অংশেও। বুজে যাওয়া এলাকায় গজিয়ে উঠছে পাকা বাড়ি। কলকাতার কেষ্টপুর এলাকার বাসিন্দা সুভাষ রায় যেমন বলছিলেন, “বিষ্ণুপুরের লালবাঁধের অনেক কাহিনি শুনেছি। এক সময় টলটলে জল ছিল। রাজা রঘুনাথ সিংহ ও তাঁর প্রেমিকা লালবাঈকে এই বাঁধেই ডুবিয়ে মেরেছিলেন রানি চন্দ্রপ্রভা। ‘পতিঘাতিনী সতী’ নামে এই নিয়ে বিখ্যাত যাত্রাপালাও দেখেছি। পড়েছি রমাপদ চৌধুরীর ‘লালবাঈ’ উপন্যাস।’’ তাঁর ক্ষোভ, ‘‘এখন এ কী চেহারা হয়েছে সেই বাঁধের! আগে বহু পরিযায়ী পাখি আসত। জল নোংরা হওয়ায় তাদেরও দেখা নেই।’’
কালিন্দীবাঁধের অধের্কটাই প্রায় মজে গিয়েছে। কৃষ্ণ ও শ্যামবাঁধেরও একই অবস্থা। বিষ্ণুপুরের সম্পদ এই সব বাঁধের সংস্কারে নতুন কোনও পরিকল্পনাও চোখে পড়ছে না। পরিবেশ রক্ষায় জলাশয়ের সংরক্ষণ ও নতুন জলাভূমি খনন নিয়ে যখন দেশ জুড়ে চলছে নানা স্তরে আলোচনা, তখন আরও একটি বিশ্ব জলাভূমি দিবসে কী ভাবনা বিষ্ণুপুর মহকুমা প্রশাসন বা পুরসভার?
বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসক পলাশ সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, লালবাঁধ সংরক্ষণ ও সৌন্দার্যায়ন নিয়ে কিছু পরিকল্পনা প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে আলাপ-আলোচনাও চলছে। একই দাবি বিষ্ণুপুরের উপ-পুরপ্রধান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়ের। যদিও সেই পরিকল্পনা প্রস্তাবে ঠিক কী আছে, তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি দু’জনেই।
এলাকাবাসীর কিন্তু দাবি, যেমন করেই হোক বাঁধগুলি বাঁচানোর উদ্যোগ শুরু হোক। কারণ, তাঁদের মতে, আগামী দিনে জল সমস্যা মোকাবিলায় এই বাঁধগুলি হতে পারে আশার আলো।