রাস্তায় কর্মীরা। গাড়িতে আটকে যাত্রীরা। পুরুলিয়া সৈনিক স্কুলের কাছে তোলা নিজস্ব চিত্র।
সংগঠন জোরাল করতে ফের অবরোধের পথে নামল পুরুলিয়া জেলা সিপিএম। আর তার জেরে মঙ্গলবার পুরুলিয়া শহরে ঢোকার চারটি রাস্তা দিনের ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টা দুয়েক ধরে অবরুদ্ধ হয়ে থাকল। গরমে গাড়িতে আটকে পড়ে চরম নাকাল হলেন যাত্রীরা। বাঁকুড়ায় জেলাশাসকের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয়।
কৃষকদের ফসলের নায্য দাম, একশো দিনের কাজ, কাজের মজুরি, শিল্পের পরিবেশ ফেরানো, বিরোধীদের অধিকার দেওয়া-সহ নানা দাবিতে মঙ্গলবার অবরোধ কর্মসূচি নিয়েছিল সিপিএমের কৃষক সংগঠন ‘সারা ভারত কৃষক সভা’ এ দিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পুরুলিয়া শহরে ঢোকার প্রধান চারটি রাস্তা অবরোধ শুরু করে। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া (৬০-এ নম্বর), পুরুলিয়া-জামশেদপুর (৩২ নম্বর) ও পুরুলিয়া-বোকারো (৩২ নম্বর) জাতীয় সড়ক এবং পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক আটকে রাখেন অবরোধকারীরা। এর জেরে ঘণ্টা দুয়েক ধরে ওই চারটি রাস্তায় পুরুলিয়া শহরে কোনও যাত্রিবাহী বাস বা গাড়ি ঢুকতে পারেনি। একই ভাবে কোন গাড়িও শহর ছেড়ে বেরোতেও পারেনি। পুরুলিয়া-জামশেদপুর জাতীয় সড়কে শিমুলিয়া মোড়ে, পুরুলিয়া-বাঁকুড়া সড়কে তেলকল পাড়া মোড়ে, পুরুলিয়া-বোকারো সড়কে সৈনিক স্কুলের কাছে এবং পুরুলিয়া-বরাকর সড়কে বোঙাবাড়ি মোড় অবরোধ করেন দলের নেতা-কর্মীরা। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বাসুদেব আচারিয়া, জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপ-সহ জেলা কমিটির শীর্ষ নেতারা এ দিন বিভিন্ন জায়গায় অবরোধে সামিল হয়েছিলেন।
অবরোধ করার কথা সিপিএম নেতৃত্ব আহে ঘোষণা করলেও সবার কাছেই যে তা পৌঁছেছিল এমন নয়। আবার অনেকে অবরোধের খবর জানলেও পেশার দায়ে বা অন্য কোনও প্রয়োজনে ওই সময়েই পথে বেড়িয়েছিলেন। তীব্র গরমে অবরোধে আটকে পড়ায় চারটি পয়েন্টে মানুষজনকে দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়। অবরোধের জায়গায় অ্যাম্বুলেন্স ও পরীক্ষার্থীদের ছেড়ে দেওয়া হয় বলে দলের জেলা নেতৃত্ব দাবি করেছেন। কিন্তু অনেক রোগীই বাসে বা গাড়িতে ছিলেন। তাঁরা কি ছাড় পেয়েছিলেন?
সৈনিক স্কুলের কাছে অবরোধে আটকে পড়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের ঝরিয়ার বাসিন্দা বৈদ্যনাথ মিশ্র। তিনি পুরুলিয়ায় মানসিক হাসপাতালে একজনকে চিকিৎসার জন্য গাড়িতে করে নিয়ে আসছিলেন। বৈদ্যানাথবাবু বলেন, ‘‘অবরোধকারীদের চিকিৎসার কাগজপত্র দেখিয়েছিলাম। কিন্তু ছাড়া পেলাম না। অ্যাম্বুলেন্স নেই বলে কি আমরা অবরোধে ছাড় পাব না?’’ ঝাড়খণ্ডের বোকারো থেকে পুরুলিয়া শহরে চোখের চিকিৎসা করাতে আসছিলেন ইন্দ্রদেব ঠাকুর। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘ওঁদের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখালাম। তাও ছাড়া পেলাম না।’’ আড়শা থেকে পুরুলিয়া সদর হাসাপাতালে আসছিলেন বুড়ি সিং সর্দার। তিনিও আটকে পড়েছিলেন শিমুলিয়ায়। অবরোধে আটকে পড়ে তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে যাব। কিন্তু সেই সকাল থেকে অবরোধে আটকে পড়েছি। ছাড়া পাওয়ার পরে হাসপাতালে ডাক্তার পাব কি না কে জানে?’’’
আটকে পড়া মানুষজন কেউ বাসের মধ্যেই গরমে পুড়তে থাকে। অনেকে আবার বাস থেকে নেমে হেঁটে শহরের দিকে রওনা দেন। কিন্তু সঙ্গে শিশু বা ভারী জিনিসপত্র থাকা লোকজনকে বাধ্য হয়েই বসে থাকতে হয়। কারণ শহরও তো কাছে নয়। তেলকল পাড়ায় সিদ্ধেশ্বর মাহাতো নামে এক মোটরবাইক আরোহী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘এ ভাবে মানুষজনকে এতটা কষ্টের মধ্যে রেখে অবরোধ অন্দোলন করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নেতাদের ভেবে দেখা দরকার। প্রতিবাদ হোক, দাবিও থাক কিন্তু মানুষজনকে এতটা হয়রানির মধ্যে ফেলে কী লাভ?’’ যাত্রীদের মধ্যে অনেকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে মানুষকে বিপদে ফেলে কী করে সিপিএমের সংগঠন বা সমর্থন বাড়বে?’’
তবে সারা ভারত কৃষক সভার পুরুলিয়ার জেলা সম্পাদক কাশীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি, ‘‘কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছেন না, কৃষি পেনশন নেই, একশো দিনের কাজ নেই, কাজ করলে আবার মজুরি মেলে না। শিল্পও আসেনি। বিরোধী পঞ্চায়েত সদস্যদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মানুষের স্বার্থেই আমরা অবরোধে নেমেছিলাম।’’ বাসুদেব আচারিয়ার কটাক্ষ, ‘‘একদিকে কৃষক আত্মহত্যা করছে, অন্যদিকে রাজ্য সরকার মেলা করছে। এর প্রতিবাদ জানাতেই পথে নেমেছি। অন্যদেরও পথে নামার আহ্বান জানাচ্ছি।’’
কিন্তু পুলিশ কী করল? অবরোধস্থলে পুলিশ বাহিনী থাকলেও তাদের অবরোধ তুলতে কোথাও খুব একটা সক্রিয় ভাবে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ। তবে এক পুলিশ কর্তার মন্তব্য, ‘‘জোর করে অবরোধ তুলতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবরোধকারীদের সরে যাওয়ার জন্য আলোচনা করা হয়।’’