দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশই সার। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে ‘লাল কার্ড’-ই দেখতে হল পুরুলিয়া জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ দফতরের কর্মাধ্যক্ষ উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়কে! অনাস্থার ধাক্কায় পদ খোয়ালেন তিনি।
জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ দফতর সংক্রান্ত স্থায়ী সমিতির চার সদস্য বর্ধমান বিভাগের কমিশনারকে উত্তমবাবুর অপসারণ চেয়ে অনাস্থার চিঠি দিয়েছিলেন গত ২১ জুন। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে শুক্রবার জেলা পরিষদেই তলবি সভা ডাকা হয়েছিল। অনাস্থা আনা চার সদস্য পুষ্প বাউরি, অনাথবন্ধু মাজি, বড়কারাম টুডু ও সুধীর সোরেন এ দিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন। পদাধিকার বলে জেলা পরিষদের সভাধিপতি ও সহ- সভাধিপতিও স্থায়ী সমিতির কার্যকলাপে থাকতে পারেন। সেই হিসাবে এ দিনের সভায় ছিলেন সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো। সভায় দলেরই সদস্যদের ভোটে অপসারিত হলেন উত্তমবাবু। এমনকী, কর্মাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন খোদ সভাধিপতিও।
রুদ্ধদ্বার কক্ষে মাত্র মিনিট পনেরোর মধ্যেই সভা শেষ হয়ে যায়। ওই সভার প্রিসাইডিং অফিসার তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) অরিন্দম দত্ত জানান, সভায় পাঁচ জন সদস্য অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ফলে কর্মাধ্যক্ষ অপসারিত হয়েছেন। এ বার এই রিপোর্ট কমিশনারের দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখান থেকে যা নির্দেশ হবে, জেলা প্রশাসন সেই অনুযায়ী কাজ করবে।
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে দলেরই একাংশের অনাস্থা আনা নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট। কোনও সমস্যা থাকলে সদস্যেরা দলের জেলা নেতৃত্বকে তা জানাতে পারবেন। কিন্তু দলেরই কারও বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা যাবে না। দরকার হলে বিক্ষুদ্ধরা দল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারেন। এই নির্দেশের পরে উত্তমবাবুকে সরাতে পূর্বনির্ধারিত তলবিসভা হবে কি না তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল জেলা তৃণমূলের একাংশে। শুক্রবারের ঘটনার পরে জেলা তৃণমূলের একাধিক নেতাই মানছেন, শেষ অবধি উত্তমবাবুর পদ খোয়ানো বুঝিয়ে দিল, পুরুলিয়া জেলা পরিষদে তাঁদের দলের গোষ্ঠী-কোন্দল কতটা মাত্রাছাড়া হয়েছে।
অপসারিত কর্মাধ্যক্ষ এ দিন সরাসরি তোপ দেগেছেন সৃষ্টিধরবাবুর বিরুদ্ধে। উত্তমবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমাকে সরিয়ে দেওয়ার পরে সভাধিপতির স্বেচ্ছাচারিতা বাড়বে।’’ যা শুনে সভাধিপতি বলে দিচ্ছেন, ‘‘ওঁকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল বলেই অনাস্থা আনা হয়েছে। কেননা উনি বারবার ফাউল করবেন, নির্বাচনে আমাদের দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করবেন, তা তো হয় না। উত্তমবাবুকে লালকার্ড দেখতেই হত! সেটাই হয়েছে!’’
বস্তুত, কর্মাধ্যক্ষ ও সদস্যদের একাংশের সঙ্গে সভাধিপতির বিরোধের কথা এখন আর অজানা নয়। সেই বিরোধ গড়িয়েছে দলনেত্রী থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত। জেলা পরিষদেরই একটি স্থায়ী সমিতিতে কর্মাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনাস্থার খবরও পৌঁছয় দলের শীর্ষস্তর পর্যন্ত। তৃণমূল সূত্রের খবর, তার পরেই রাজ্য নেতৃত্বের কাছ থেকে জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোর কাছে নির্দেশ আসে, এ ভাবে অনাস্থা আনা যাবে না। অনাস্থার তলবি সভা যাতে না হয়, তা দেখবেন বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েওছিলেন শান্তিরামবাবু।
কিন্তু, তার চব্বিশ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই দলের সদস্যদের ভোটে দলেরই কর্মাধ্যক্ষ অপসারিত হওয়ায় খানিকটা অবাকই হয়েছেন সাধারণ তৃণমূল কর্মীরা। তাঁদের প্রশ্ন, দলের সভাপতির নির্দেশ অমান্য করে কী ভাবে এই ঘটনা ঘটতে পারে? জেলা পরিষদে তৃণমূলের দলনেতা সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি বাইরে রয়েছি। তবে, অপসারণের ঘটনা শুনে অবাকই হয়েছি।’’
দলের নিচুতলার কর্মীদের বড় অংশই জানাচ্ছেন, এই অপসারণ ছিল সময়ের অপেক্ষা। উত্তমবাবুকে পদচ্যুত করার ছক অনেক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের মতে, উত্তমবাবু ছিলেন জেলা পরিষদের অভ্যন্তরে প্রতিবাদীদের মধ্যে পুরোভাগে। উন্নয়নের অর্থ বরাদ্দ, কোন প্রকল্প কোথায় হবে— এ রকম নানা বিষয়ে সৃষ্টিধরবাবুর সঙ্গে উত্তমবাবুর গত আড়াই বছরে একাধিক বার বিরোধ বেধেছে। মুখ্যমন্ত্রীকেও জেলা পরিষদের বিরোধ মেটাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। উত্তমবাবুর অনুগামীদের দাবি, জেলা পরিষদে কোনও বিরোধী কন্ঠস্বরের অস্তিত্ব সভাধিপতির না পসন্দ। তাই বিধানসভা ভোট মিটতেই উত্তমবাবুকে সরিয়ে দেওয়া হল।
যদিও এই ঘটনাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন সভাধিপতি। তিনি বলেন, ‘‘এই স্থায়ী সমিতির সদস্যেরা কর্মাধ্যক্ষকে চাইছিলেন না। তাই তিনি অপসারিত হয়েছেন।’’ আপনি কেন বিরুদ্ধে ভোট দিলেন? সভাধিপতির জবাব, ‘‘আমার সদস্যেরা যেখানে তাঁকে চান না, আমি কী ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে যাব?’’ দলের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন অনাস্থা আনা হল, সে প্রসঙ্গে সৃষ্টিধরবাবুর বক্তব্য, ‘‘কী নির্দেশ ছিল, তা আমি মিডিয়াকে কেন জানাব? সেটা আমাদের দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে বলতে পারি বাজারে নানা আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদা হচ্ছে এই অনাস্থা নিয়ে।’’
অপসারিত কর্মাধ্যক্ষ উত্তমবাবুর অবশ্য দাবি, তাঁর অপসারণের পিছনে সভাধিপতির পাশাপাশি জেলা সভাপতিরও মদত রয়েছে। শান্তিরামবাবু এই অভিযোগের উত্তর এড়িয়ে শুধু বলেছেন, ‘‘ঘটনাটি শুনেছি, দলের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের কাছে রিপোর্ট করব।’’ তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুকুল রায় বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।