নিতুড়িয়ার পথে। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
ব্লক সভাপতি ও বিধায়কের মধ্যে সম্পর্কের ফাটলটা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে।
ইঙ্গিতটা মিলেছিল বিধানসভা নির্বাচনের আগেই। নির্বাচন পর্বে বারবার রঘুনাথপুরে তৃণমূলের প্রার্থী পূর্ণচন্দ্র বাউরির সঙ্গে নিতুড়িয়ার ব্লক সভাপতির চাপা দ্বন্দ্ব বারবার সামনে এসেছিল। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে নির্বাচনে নিতুড়িয়ার ব্লক সভাপতি তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শান্তিভূষণপ্রসাদ যাদবের অনুগামীরা অন্তর্ঘাত করতে পারেন বলে আশঙ্কা তৈরি হয় পূর্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠদের মনে।
পূর্ণচন্দ্রবাবুর জয়ের পরে সোমবার নিতুড়িয়ায় দলের বিজয়মিছিলে শান্তিভূষণবাবুর অনুপস্থিতি নতুন করে সেই দ্বন্দ্বের ছবিটাই যেন সামনে এনে দিল। দলের নিতুড়িয়া ব্লক কমিটির অয়োজিত বিজয় উৎসবে খোদ ব্লক সভাপতিই কেন গরহাজির? এই প্রশ্ন উঠল দলের কর্মীদের মধ্যে। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে শান্তিভূষণবাবুর জবাব, ‘‘বিজয় উৎসব হচ্ছে? জানতাম না তো! ওই কর্মসূচি নিয়ে কেউ আমাকে কিছুই জানাননি।’’ তাঁর দাবি, এ দিন তিনি ব্যক্তিগত কাজে বিহারে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন।’’ তবে নিন্দুকদের মন্তব্য, তিনি ওই কর্মসূচির কথা আগেভাগেই জানতেন। এলাকায় থেকেও মিছিলে না হাঁটলে বিতর্ক হবে, তাই বিহারে চলে গিয়েছেন। তবে এ নিয়ে আর মন্তব্য করতে চাননি শান্তিভূষণবাবু। বিধায়ক পূর্ণচন্দ্রবাবুর অবশ্য এই বিতর্ক নিয়ে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তাঁকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। উত্তর দেননি এসএমএস-এরও।
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে রাশ টানতে চাইলেও দলের নিচুতলায় দলনেত্রীর বার্তার কোনও প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। রঘুনাথপুরের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। বিধায়কের নির্দেশ অমান্য করে সম্প্রতি রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূলেরই সভাপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছেন দলেরই সদস্যেরা। এ বার নিতুড়িয়ায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনা সামনে এল। বস্তুত পাঁচ বছর আগের ভোটের ব্যবধানকে এ বার পূর্ণচন্দ্রবাবু ছাপিয়ে যেতেই নিতুড়িয়ায় ব্লক সভাপতিকে নির্দিষ্ট বার্তা দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ওই ব্লকে বিধায়কের অনুগামীরা। কিন্তু বিধানসভা ও ব্যক্তিগত কাজে পূর্ণচন্দ্রবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তাঁকে নিয়ে বিজয় উৎসব করার সময় পাচ্ছিলেন না বিধায়কের ঘনিষ্ঠেরা। স্থির হয় সোমবার নিতুড়িয়ায় এই বিজয় উৎসব হবে। দল সূত্রে খবর, সেই মতো শান্তিভূষণবাবুর অনুগামীদের বাদ দিয়েই ওই মিছিলের প্রস্তুতি শুরু হয়। এ দিন পারবেলিয়া থেকে সড়বড়ি পর্যন্ত মিছিলে পুলিশের হিসেবেই হাজার পাঁচেক লোক হয়েছিল।
নির্বাচনে নিতুড়িয়া থেকে মাত্র ১৩০০-র কিছু বেশি ভোটে লিড পেয়েছেন পূর্ণচন্দ্রবাবু। তৃণমূলের বরাবরের শক্ত ঘাঁটি নিতুড়িয়ায় পঞ্চায়েত সমিতি গত দশ বছর ধরে তৃণমূলের দখলে, ছ’টি পঞ্চায়েতের মধ্যে পাঁচটিই শাসকদলের দখলে। দুই জেলা পরিষদের সদস্যও তৃণমূলের। তারপরেও বিধায়ক নিজে নিতুড়িয়ার বাসিন্দা। এই সমীকরণ হওয়া সত্ত্বেও পুরো ব্লকে মাত্র একহাজারের কিছু বেশি ভোটে লিড মানতে পারেনি বিধায়কের ঘনিষ্ঠেরা।
দলীয় তদন্তে প্রাথমিক ভাবে উঠে এসেছে নির্বাচনে ঘাসফুলের বদলে পদ্মফুলে তৃণমূলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের ভোট দেওয়ার জন্য বলেছিল দলেরই একাংশ। এবং তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন শান্তিভূষণবাবু। ব্লক সভাপতি-সহ তাঁর অনুগামীরা নির্বাচনে অন্তর্ঘাত করেছেন বলে পরিসংখ্যান দিয়ে সেই দাবি তুলেছেন বিধায়কের অনুগামীরা। তাঁদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলেরই দখলে থাকা শালতোড়া পঞ্চায়েতের আমডাঙার (যেখানের বাসিন্দা শান্তিভূষণবাবু) দু’টি বুথেই তৃণমূলের থেকে এগিয়ে বিজেপি ও সিপিএম। ব্লক সভাপতির ঘনিষ্ঠ তথা জেলাপরিষদের এক কর্মাধ্যক্ষের এলাকা মল্লিকপাড়া তিন নম্বরে। সেখানে বড় ব্যবধানে এগিয়ে সিপিএম। তবে স্বভাবতই এইসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন ব্লক সভাপতি।
তবে সোমবারের মিছিল সিপিএম ও বিজেপির কার্যালয়গুলোর থেকে বেশি বাজি ফেটেছে, সবুজ আবির উড়েছে পারবেলিয়ার আমডাঙায় শান্তিভূষণবাবুর বাড়ির কাছে। সব মিলিয়ে নির্বাচন মিটতেই শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিতুড়িয়াতে মাথাচাড়া দিয়েছে।