পানায় ঢাকা সাহেববাঁধ। ছবি: সুজিত মাহাতো
শহরের ‘ফুসফুস’ আজ নিজেই যেন শ্বাস নিতে পারছে না। কচুরিপানায় ঢাকা হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে জাতীয় সরোবরের তকমা পাওয়া পুরুলিয়া শহরের সাহেব বাঁধ কবে তার স্বাভাবিক চেহারায় ফিরবে, প্রশ্ন তুলছেন শহরবাসীর একাংশ।
প্রায় ১৮০ বছর আগে মানভূমের তৎকালীন ডিসি কর্নেল টিকেলের তত্ত্বাবধানে ৮৫ একর জমিতে খনন করা এই জলাশয়ের সঙ্গে পুরুলিয়া শহরের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। তবে, সময়ে সময়ে জলাশয়ের বেহাল স্বাস্থ্য় ব্যথিত করেছে শহরবাসীকে। জাতীয় সরোবরের তকমা পেলে রক্ষণাবেক্ষণে নজর থাকবে বেশি, সেই আশা থাকলেও বাস্তবে তা পূরণ হয়নি বলে আক্ষেপ অনেকের। জাতীয় সরোবরের তকমা পাওয়ার আগে, জলাশয়টি রক্ষায় শহরের কিছু বিশিষ্ট জনকে নিয়ে তৈরি কমিটির মুখপাত্র আবু সুফিয়ান বলেন, “আমরা যখন সাহেব বাঁধ বাঁচাতে আন্দোলন শুরু করি, তখন বাঁধের অত্যন্ত খারাপ অবস্থা। জাতীয় সরোবরের মর্যাদা পাওয়ার পরে পাড়ের চারপাশ ঝাঁ চকচকে হলেও বাঁধের দিকে সে ভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে কই! কচুরিপানায় বাঁধের বিস্তীর্ণ অংশ ঢেকে রয়েছে। অবিলম্বে সাফাই করা দরকার।”
একই মত শহরের বাসিন্দা, চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায়ের। তিনি জানান, কচুরিপানায় জলাশয়ের বেশিরভাগ ঢাকা পড়ায় জলে সূর্যের আলো পৌঁছচ্ছে না। এতে জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের। তাঁর কথায়, “পুরুলিয়া এমনিতেই শুষ্ক এলাকা। শহরের প্রতিটি জলাশয়কেই তাই অত্যন্ত যত্নে রক্ষা করা দরকার। আমরা এই জলাশয় রক্ষায় অবিলম্বে গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু করছি। মাধ্যমিকের পরে আন্দোলনেও নামব। তা ছাড়া, বাঁধরক্ষায় প্রয়োজনে ন্যাশনাল লেক কনজ়ারভেশন অথরিটির বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।” কচুরিপানা বেড়ে জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছেন জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্রের আধিকারিক ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় ও সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক সুব্রত রাহাও। তাঁদের মত, অবিলম্বে সাহেববাঁধের কচুরিপানা সরানোর পাশাপাশি জলাশয়ের স্বাস্থ্যরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দরকার। জলাশয় ব্যবহারকারীদেরও এ নিয়ে সচেতন করতে হবে।
জলাশয়ের চেহারা বদলে কমেছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা, জানাচ্ছিলেন শহরের বাসিন্দা সত্যদাস কুণ্ডু। তিনি বলেন, “পুজোর আগেও জলাশয় পরিষ্কার ছিল। এখন কচুরিপানার কারণে এমনই অবস্থা যে, জল দেখা যায় না। আগে শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসত। দিনে দিনে তা-ও কমছে।” আর এক বাসিন্দা দেবকুমার দাঁ-র প্রশ্ন, “এই জলাশয়ের সঙ্গে আমাদের ভাবাবেগ জড়িয়ে রয়েছে। দিনের পর দিন এই চেহারায় সাহেব বাঁধকে দেখা যায় না। একটা জাতীয় সরোবরের কেন এমন অবস্থা হবে!”
সাহেব বাঁধের অনাদরে থাকার কথা মানছেন তৃণমূলের পুর-প্রতিনিধি রবিশঙ্কর দাসও। তিনি বলেন, “সাহেব বাঁধ নিয়ে যে সব প্রশ্ন উঠছে, তা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এক দিকে জলাশয় ঢেকে যাচ্ছে কচুরিপানায়, আর অন্য দিকে পুরসভা পাড় জুড়ে বিজ্ঞাপনের বোর্ড লাগাতে উদ্যোগী হচ্ছে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।”
পুরসভা যদিও জানাচ্ছে, সাহেব বাঁধের স্বাস্থ্যরক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ হয়েছে। প্রথমত, শহরের নিকাশি-জল সাহেব বাঁধে ফেলা বন্ধ করা হয়েছে। জলাশয়ে স্নান বা জামাকাপড় কাচা নিষিদ্ধ। এ ছাড়া, গোটা জলাশয় রেলিং দিয়ে ঘেরা হয়েছে। পুরপ্রধান নবেন্দু মাহালি জানান, পুজোর আগে গোটা জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়েছিল। তবে জলাশয় ফের সাফাই করতে যে অর্থ প্রয়োজন, পুরসভায় তার আলাদা বরাদ্দ নেই। তবু কী করা যায়, দেখা হবে। জাতীয় সরোবরের তহবিল থেকে সাফাইয়ের কাজ করা যায় কি? পুরপ্রধানের দাবি, “সাহেব বাঁধকে জাতীয় সরোবর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এমন কোনও ফাইল পুরসভায় নেই।” তাঁর সংযোজন, “শুধু বাঁধের পানা পরিষ্কার করলেই হবে না। জলেও দূষণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সামগ্রিক ভাবে বাঁধের স্বাস্থ্যোদ্ধারে পুরসভা কাজ করবে।”