বান্দোয়ানের একটি পাম্পে শনিবার পেট্রলের দর। ছবি: রথীন্দ্রনাথ মাহাতো।
উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিঙের পরে, পুরুলিয়া। শুক্রবার জেলা শহর পুরুলিয়া-সহ জেলার একাধিক জায়গায় পেট্রলের দর একশো ছুঁয়েছে। কোথাও আবার তা প্রায় একশো ছুঁইছুঁই। পুরুলিয়া শহরের রাঁচী রোডের একটি পেট্রল পাম্পে শনিবার তেল ভরতে আসা এক যুবকের টিপ্পনী, ‘‘পুরুলিয়া পিছিয়ে পড়া জেলা হলেও পেট্রলের দামে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে।’’
বান্দোয়ানে শনিবারও পেট্রলের দর ছিল লিটার প্রতি ১০০.০২ টাকা। মানবাজার ২-এর আঁকরোয় ১০০.১০ টাকা, বলরামপুরে ১০০.৩২ টাকা, ঝালদায় ১০০.৪০ টাকা প্রতি লিটার। এ দিকে, শহরের উপকণ্ঠে পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কের ছড়রায় তা ৯৯.৯২ টাকা বা পুরুলিয়া-বাঁকুড়া (৬০এ) জাতীয় সড়কের গেঙাড়ায় তা ছিল ৯৯.৯৭ টাকা প্রতি লিটার। একশো ছুঁইছুঁই অবস্থা কাশীপুর ও মানবাজারেও (৯৯.৭৭ টাকা প্রতি লিটার)।
একই জেলার ভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন দাম কেন? জেলার পেট্রল পাম্প মালিক সংগঠনের তরফে প্রদ্যুৎকুমার দাস বলেন, ‘‘লিটার প্রতি দাম কোনও পেট্রল পাম্প ধার্য করে না। দুর্গাপুরের রাজবাঁধ এলাকায় এ অঞ্চলের পেট্রল মজুত হয়। এক-একটি তেল সরবরাহকারী সংস্থার তরফে সংশ্লিষ্ট সংস্থার পাম্প যেখানে রয়েছে, সেখানে তেল পৌঁছে দেওয়া হয়। রাজবাঁধ থেকে যে এলাকার দূরত্ব যত, দাম নির্ভর করে তার উপরেই।’’ আর দাম-বৃদ্ধি নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিক্রি কমলেও ‘কমিশন’ একই রয়েছে। তেলের দাম বাড়ায় ব্যবসায় বেশি টাকা ঢালতে হচ্ছে। অথচ
রোজগার বাড়েনি।’’
পেট্রলের দর একশো ছোঁয়ায় ক্ষোভের আঁচ সাধারণের প্রতিক্রিয়ায়তেও। পুরুলিয়ার একটি ব্লকে কর্মরত রাজ্য সরকারি কর্মী নিয়ামুল খানকে বাঁকুড়া থেকে যাতায়াত করতে হয়। তাঁর কথায়, ‘‘বাস-ট্রেন না থাকায় মোটরবাইকেই যাতায়াত করতে হচ্ছে। প্রতিদিন দু’শো টাকার বেশি তেল লাগে। আজ তো পেট্রল একশো টাকা ছুঁয়ে ফেলল। খরচ আরও বাড়বে।’’ আসানসোল থেকে মালপত্র কিনে জেলার বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করা গৌরাঙ্গডির বাসিন্দা বাপ্পা হালদারও জানান, জ্বালানি তেলের দাম একেবারে নিয়ম করে বেড়ে চলেছে। রোজগার তো বাড়েনি। ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ মানুষের কথা কারও ভাবার
সময় নেই।
ওয়েস্ট বেঙ্গল চেম্বার অব্ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক বামাপ্রসাদ পুইতুণ্ডি বলেন, ‘‘এ ভাবে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়লে তার প্রভাব সামগ্রিক ভাবে জনজীবনে পড়বে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়বে। সরকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।’’
জেলায় পেট্রলের দাম সেঞ্চুরি ছোঁয়ার দিনে বিজেপিকে বিঁধতে ছাড়েনি তৃণমূল। জেলা তৃণমূলের মুখপাত্র নবেন্দু মাহালি বলেন, ‘‘এই হচ্ছে ‘অচ্ছে দিন’। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর উদাহরণ। আন্তর্জাতিক বাজারের উপরে তেলের দাম নির্ভর করলে দাম কি এতটা বাড়তে পারে? পেট্রোপণ্যের দাম বাড়লে শুধু যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁদেরই বাড়তি অর্থ গুনতে হবে তা তো নয়। এর প্রভাব পড়বে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দামেও।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘পেট্রোপণ্যের দাম নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের উপরে। রাজ্য সরকার যে ‘সেস’ নেয়, তা কমালেই তো দাম কমে যায়।’’
এ দিকে, একশো না ছুঁলেও পিছিয়ে নেই লাগোয়া জেলাগুলি। বাঁকুড়ায় এ দিন পেট্রলের দাম জায়গা ভেদে ৯৯.২৭ টাকা থেকে ৯৯.৬৭ টাকা প্রতি লিটার ঘোরাফেরা করেছে। লাগোয়া জেলা পূর্ব বর্ধমানে (৯৯.৩৬ টাকা প্রতি লিটার) একই অবস্থা। পশ্চিম বর্ধমানে দাম তুলনায় কিছু কম (৯৮.৩৯ টাকা প্রতি লিটার)। পেট্রোলিয়াম ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য কমিটির সদস্য বিষ্ণু বাজোরিয়া বলেন, ‘‘পেট্রল পাম্পের ব্যবসা চালানো দিন-দিন সমস্যার হয়ে উঠছে। কমিশন না বাড়লেও বিনিয়োগ বাড়ছে। খরচও বাড়ছে। ডিজেলের বিক্রি আগেই তিরিশ শতাংশে নেমে এসেছে। পেট্রলের বিক্রিও কমবে।’’
তেলের দামে হিমসিম অবস্থা মানুষজনেরও। বড়জোড়ার শুভাশিস গুপ্ত বলেন, ‘‘এখানেও পেট্রল একশো ছুঁতে চলল। যা অবস্থা, আবার সাইকেলে ফেরা ছাড়া উপায় নেই।’’ বাঁকুড়া শহরের এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী অমিত মণ্ডলও জানান, বাস এখনও সে ভাবে চলছে না। মোটরবাইকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুরে যাতায়াত করতে হয়। পেট্রলের যা দাম, তাতে পকেটেকিছু থাকছে।
পেট্রলের অস্বাভাবিক দামের জন্য সরকারি নীতির দিকে আঙুল তুলে বাঁকুড়া চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সম্পাদক মধুসূদন দরিপা বলেন, ‘‘সব জিনিসের দাম বাড়বে। দেশে বড়সড় বিপর্যয় আসতে চলেছে। নিম্নবিত্ত, গরিবদের দিন গুজরান করা সমস্যার হবে।’’