অন্য ভূমিকায়: স্ট্রেচারে আঙ্গুরি। নিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার। ছবি: শুভ্র মিত্র
মাঝরাতে ভাই-বোনের কামড়া-কামড়িতে লোকজন যতটা চমকেছেন, তার থেকে ওই রোগীদের বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতাল ভর্তি করাতে গিয়ে বেশি তাজ্জব হওয়ার ঘটনা ঘটল। কর্মীর দেখা না পেয়ে এক হাতে স্যালাইনের বোতল ধরে রোগিণীর স্ট্রেচার ঠেলতে হল ডাক্তারকেই!
কাঁকিল্যা গ্রামের আঙ্গুরি রুইদাস ও তাঁর ভাই মাধব রুইদাসের শুক্রবার রাতে প্রথমে স্থানীয় রাধানগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। পরে শনিবার সকালে বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে তাঁদের পাঠানো হয়।। কিন্তু সেখানে তাঁদের জন্য কী অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল, তাঁরা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি। আহত দুই ভাই-বোনকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসেন পিনাকী মুখোপাধ্যায়।
তাঁর অভিযোগ, ‘‘মানসিক রোগী অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে কয়েকবার কামড়াতে এসেছিলেন। ভেবেছিলাম হাসপাতালে গিয়ে রক্ষীদের নজরে ওকে রেখে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাব। কিন্তু গেটে কোনও রক্ষীই ছিলেন না। রোগী সহায়তা কেন্দ্রেও কোনও কর্মীর দেখা পাইনি। স্ট্রেচার ঠেলবে কে? শেষে উপায় না পেয়ে আঙ্গুরিদেবীকে স্ট্রেচারে শুইয়ে তাঁর আহত ভাইকে নিয়েই ঠেলে নিয়ে যাই। অন্য রোগীর পরিজনেরাও হাত লাগান।’’
সেখানেই শেষ নয়। তাঁদের অভিযোগ, জরুরি বিভাগের ভিতরে তখন এক মদ্যপ ঢুকে দুই ডাক্তারকে বিরক্ত করছিল। অন্য রোগীর পরিজনেরা সেই মদ্যপকে ঠেলে সরিয়ে দেন। মাধবকে ভর্তি করে নেওয়া হলেও, আঙ্গুরির অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে স্থানান্তর করে দেন ডাক্তাররা। কিন্তু ফের তাঁকে স্ট্রেচারে অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত নিয়ে যাবেন কে? মাধবের দৌরাত্ম্যে ততক্ষণে রোগীদের পরিজনেরাও সরে গিয়েছিলেন। এ দিকে রোগিণীকে বেশিক্ষণ ফেলে রাখাও ঝুঁকির। শেষে জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসকই স্টেথোস্কোপ কাঁধে ঝুলিয়ে এক হাতে স্যালাইনের বোতল, অন্য হাতে স্ট্রেচার ধরে অন্যদের সঙ্গে আঙ্গুরিদেবীকে হাসপাতাল থেকে বের করে আনেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁকুড়ার পথে আঙ্গুরিদেবী মারা যান।
ওই ঘটনার সাক্ষী বিষ্ণুপুরের শেখ পাড়ার বাসিন্দা শেখ মহম্মদ ইদ্রিশ প্রশ্ন তোলেন, ‘‘কে বলবে এটা জেলা হাসপাতাল? না আছে রোগী সহায়তা কেন্দ্রে কোনও লোক, না কোনও নিরপত্তা রক্ষী! জরুরি বিভাগের চিকিৎককেই এক হাতে স্ট্রেচার আর এক হাতে স্যালাইনের বোতল ধরে রোগীকে অ্যাম্বুল্যান্সে পৌঁছে দিতে নিয়ে যেতে হচ্ছে?’’
এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই হইচই শুরু হয়েছে বিষ্ণুপুরে। রোগী কল্যাণ সমিতির এক সদস্য অভিযোগ করেন, ‘‘কত অস্থায়ী লোক নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে, অথচ কাজের লোক ঠিক সময়ে পাওযা যায় না!’’ তাঁর কটাক্ষ, বিষ্ণুপুর হাসপাতালে এখন রোগীর থেকে অস্থায়ী কর্মীর সংখ্যা বেশি। হাসপাতাল সুপারকে সময়ে কর্মী না পাওয়ায় সমস্যা নিয়ে বহুবার বলেছি। তিনি কান দেননি।’’ বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রমেন্দ্রনাথ প্রামাণিক বলেন, ‘‘একটি বেসরকারি সংস্থাকে নিরাপত্তা রক্ষী ও রোগী সহায়তা কেন্দ্রে লোক দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া আছে। চব্বিশ ঘণ্টাই রোগী সহায়তা কেন্দ্রে লোক থাকার কথা। কিন্তু কেন এ দিন কোনও লোক থাকল না, খোঁজ নিচ্ছি।’’ যদিও হাসপাতাল সুপার পৃথ্বীশ আকুলির দাবি, ‘‘নিরাপত্তা রক্ষীর সংখ্যা কম থাকলেও রোগী সহায়তা কেন্দ্রে লোকজন থাকেন। এ দিন সকালেও ছিলেন। মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’’
যদিও জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তাই অভিযোগ তুলেছেন, ‘‘বিষ্ণুপুর হাসপাতালে নেতাদের সুপারিশে লোক নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কাজের বেলায় সেই লোকেদের পাওয়া যাচ্ছে না। এতে হাসপাতালেই পরিষেবায় বিঘ্ন হচ্ছে।’’ ঘটনাটি শুনে বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘ভিত্তিহীন অভিযোগ বলছি না। এই ধরনের অন্যায় কাজ যদি হয়ে থাকে, সেটাকে আমরা মেনে নিচ্ছি না। তৃণমূলের নাম করলেই পার পেয়ে যাবেন, এটা হবে না। অপ্রয়োজনীয় লোক থাকলে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ বিজেপি-র বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি স্বপন ঘোষেরও অভিযোগ, ‘‘বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতাল এখন শাসকদলের লোকেদের কাজ পাইয়ে দেওয়া জায়গা হয়ে উঠেছে। নেতাদের তাবেদারি করে যাঁরা কাজ পায়, তাঁরা কেন রোগীর পিছনে খাটতে যাবেন?’’