বিধ্বস্ত: মেয়েকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন বুলা রুইদাস। কোতুলপুরের তাজপুরে শনিবার। নিজস্ব চিত্র
বার্ষিক পরীক্ষায় বরাবার প্রথম তিন জনের মধ্যে নাম থাকত। উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করে নার্সিং-এর প্রশিক্ষণ নিতে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। বাঁকুড়ার কোতুলপুরের তাজপুর গ্রামের সেই সমাপ্তি রুইদাস (১৮) ‘পড়াশোনার চাপ’ নিতে না পেরে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন—এ কথা মানতে চাইছেন না তাঁর অনেক আত্মীয়-বন্ধুই।
শনিবার সকালে ফোনে মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কলকাতা রওনা হয়েছেন সমাপ্তির বাবা সুকুমার রুইদাস। এ দিন তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ভিড় করে রয়েছেন পড়শিরা। সমাপ্তির স্কুলের সহপাঠীরা অনেকে এসেছেন। এসেছেন স্কুলের এক শিক্ষকও। টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়ি। দু’টি ঘর। এক চিলতে বারান্দা। জীর্ণ দরজা দেওয়াল থেকে প্রায় উঠে আসার অবস্থা হয়েছে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, সুকুমারবাবু রঙের মিস্ত্রির কাজ করেন। তাঁর একার আয়েই চলে সংসার। স্বামী, স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে। ভাইবোনের মধ্যে সমাপ্তিই বড়। ছোট বোন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। ভাই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।
স্থানীয় তাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন সমাপ্তি। আত্মীয়েরা দাবি করেন, মাধ্যমিকে প্রায় ৭২ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিকে ৯১.৫ শতাংশ। অন্য বিষয়ের থেকে ইংরেজিতে বেশি নম্বর ছিল তাঁর। এ দিন সমাপ্তিদের বাড়িতে এসেছিলেন তাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মধুসূদন বৈরাগী। তিনি বলেন, ‘‘পড়াশোনায় খুবই ভাল ছিল সমাপ্তি। ক্লাসে বরাবর প্রথম তিন জনের মধ্যে থাকত। শিক্ষকদের অনুগত ছিল। ইংরেজি নিয়ে ওর মধ্যে কখনও কোনও ভীতি দেখিনি।’’
ওই স্কুলে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমাপ্তির সঙ্গে পড়েছেন স্থানীয় এক তরুণী। একটি কলেজে প্রথম বর্ষে পড়েন তিনি। এ দিন বন্ধুর মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। স্কুলের ওই সহপাঠীর দাবি, ক্লাসের চাপে ফোন করার ফুরসত পান না বলে সমাপ্তি তাঁকে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘ইংরেজিতে বড় বড় বই পড়তে হবে এ দিকে, রাত ১১টার পরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারত না। হয়তো তাতে চাপের মধ্যে ছিল। খাওয়াদাওয়ার অসুবিধাও ছিল।’’
বাঁকুড়া মেডিক্যালের নার্সিং সুপারিন্টেডেন্ট সরিতা পাল বলেন, ‘‘নার্সিং পড়তে যে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়, তা এমন কিছু জটিল নয়। আমাদের এখানে তো কোনও সমস্যা হলে বাংলায় কথা বলেই পড়ুয়ারা বুঝে নেন। তবে এ ক্ষেত্রে কী হয়েছিল, তা জানি না।’’ সমাপ্তির পিসি সোমা দাস ঘটনার তদন্ত দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাই, এর বিচার হোক। যেন অন্য কোনও ছেলেমেয়ের সঙ্গে এ রকম না হয়।’’
আর তৃণমূলের কোতুলপুর ব্লক সভাপতি প্রবীর গড়াই বলছেন, ‘‘এখন তো কোনও কারণে বিষণ্ণ হলে তা ভাগ করে নেওয়ার অনেক সুযোগ থাকে। সমাপ্তিও বাবার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতেন বলে শুনেছি। ঘাটতিটা কোথায় ছিল, সেটাই খুঁজে দেখা দরকার। আমরা চাই, প্রকৃত তদন্ত হোক। গ্রামগঞ্জের মেধাবী ছেলেমেয়েদের এমন পরিণতি আর যেন কখনও না হয়।’’