বাতিস্তম্ভের তার সারান হাতুড়ে, ক্ষোভ ময়ূরেশ্বরে

মুশকিল আরও বাড়ে এর পর। বিদ্যুৎ দফতরের বর্ধমান আঞ্চলিক অফিসের জরুরি পরিষেবা নম্বরে ফোন করেন কয়েক জন বাসিন্দা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৭ ০২:১১
Share:

কয়েক মাস আগের কথা। ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া মোড়ের কাছে রাস্তায় আচমকা ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুৎবাহী তার। ভিড়ে ঠাসা রাজপথে ছড়ায় আতঙ্ক।

Advertisement

মুশকিল আরও বাড়ে এর পর। বিদ্যুৎ দফতরের বর্ধমান আঞ্চলিক অফিসের জরুরি পরিষেবা নম্বরে ফোন করেন কয়েক জন বাসিন্দা। তাঁদের অভিযোগ, দীর্ঘক্ষণ ফোনের ও পারে শোনা যায় ‘বিপ-বিপ-বিপ’ শব্দ। বার বার চেষ্টার পর সংযোগ মিললেও ও পারের কণ্ঠ জিজ্ঞাসা করেন— ‘‘আপনার কনজিউমার নম্বর বলুন।’’ পুরনো বিল থেকে নম্বর খুঁজে বের করলেও ততক্ষণে ফের ফোনে ফিরে আসে ‘বিপ-বিপ-বিপ’ আওয়াজ।

জনবহুল রাস্তায় তখনও পড়ে ছিল বিদ্যুতের তার!

Advertisement

শেষে ‘লাটা’কে ডেকে পাঠান লোকপাড়া মোড় ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুভাষ ঘোষ, ব্যবসায়ী ফটিকচন্দ্র দে। গ্রামের ওই হাতুড়ে মিস্ত্রিই তখন ‘মুশকিল আসান’। ওই ব্যবসায়ীরা জানান, বাতিস্তম্ভ থেকে ব্যস্ত রাস্তার উপর ছিঁড়ে যাওয়া তার জোড়াতালি দিয়ে ফের টাঙালেন বিদ্যুতিক সরঞ্জামের ‘হাতুড়ে চিকিৎসক’ লাটা-ই।

এ কাজ যে বিপজ্জনক তা সকলেই জানেন। ওই ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ‘‘তার ছিঁড়ে যাওয়ার পর স্থানীয় বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীদের জানিয়েছিলাম। ওঁরা স্থানীয় বিদ্যুৎ বণ্টন অফিস বা বর্ধমান আঞ্চলিক দফতরে খবর দিতে বলেন। বিদ্যুৎ বণ্টন অফিসে ফোন বেজে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টার পর বর্ধমান অফিসে ফোন তুললেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’’ হাতুড়ে মিস্ত্রি দিয়ে তার টাঙানো বিপজ্জনক, বেআইনিও— সে কথা মেনে নিয়েও সুভাষবাবুরা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা জনবহুল রাস্তায় বৈদ্যুতিক তার পড়ে থাকাটাও কি কম বিপজ্জনক নয়?’’ একই বক্তব্য ওই এলাকার অনেকেরই।

অভিযোগ, এ সমস্যা শুধু ময়ূরেশ্বর থানা এলাকার নয়। জেলার অনেক প্রান্তে পরিস্থিতি এমনই। বিদ্যুতের কোনও সমস্যা হলে দ্রুত তা মেটাতে জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ‘লাটা, কেষ্ট’রাই ভরসা। ঠিক সময়ে বিদ্যুৎ দফতরের সাড়া না পেয়ে গ্রামে গ্রামে হাতুড়ে মিস্ত্রিদের দিয়েই চলছে ছিড়ে যাওয়া তার, ট্রান্সফর্মারের ফিউজ ঠিক করার কাজ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নিরুপায় হয়েই অনেক সময় তাঁরা এমন কাজ করেন। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমস্যা হয়। ফোনে বারবার চেষ্টা করলেও ও পার থেকে কারও সাড়াও কখনও কখনও মেলে না।

কোনও বিদ্যুৎ-কর্তা এ নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তবে এ সব কথা জানেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীদের একাংশ। তাঁরা জানিয়েছেন, এ ভাবে হাতুড়ে মিস্ত্রিদের দিয়ে কাজ করানোয় অনেক ক্ষেত্রে দামী সরঞ্জামের ক্ষতি হচ্ছে। বিদ্যুতের ‘ছোবল’ লাগছে হাতুড়েদেরও।

লাভপুরের দরবারপুরের আব্বাস শেখ, নানুরের রামকৃষ্ণপুরের অনিল মণ্ডলরা বলছেন, জরুরি কাজের জন্য বিদ্যুৎ দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করার সহজ উপায় নেই। রাতে কোনও এলাকায় ট্রান্সফর্মারের ফিউজ পুড়লে সকালের আগে বিদ্যুৎকর্মীদের পৌঁছনোর আশা না করাই ভাল। গোটা রাত অন্ধকারে থাকার বদলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কখনও নিজেরাই ফিউজ সারানোর চেষ্টা করেন। তার পরও তা সারানো সম্ভব না হলে ডাকেন বিদ্যুতের ‘হাতুড়ে’দেরই।

এলাকার বাসিন্দারা জানান, কয়েক দিন আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। তিনটি পঞ্চায়েত এলাকার জন্য একটি করে কল-সেন্টার চালু করে বিদ্যুৎ দফতর। কোনও সমস্যায় কল-সেন্টারে ফোন করলেই সাড়া মিলত। রাতবিরেতেও কল-সেন্টারের কর্মীরা ট্রান্সফর্মারের ফিউজ, ছিড়ে যাওয়া তার ঠিক করে পরিষেবা সচল রাখতেন। উচ্চ বিদ্যুৎ পরিবাহী তার ও ট্রান্সফর্মার মেরামতির জন্য খবর পাঠিয়ে ডেকে আনতেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মীদের।

এখন তা হচ্ছে না বলে অভিযোগ ময়ূরেশ্বরের কনুটিয়ার রমজান আলি, সাঁইথিয়ার ফুলুরের অনিল বাগদীদের। তাঁরা জানান, ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎবাহী তারের কাজ করতে আসা মিস্ত্রিদের সামনে ২২০/৪৪০ ভোল্টের তার ছিড়ে পড়ে থাকলেও, বেশির ভাগ সময় তাঁরা তা মেরামত করেন না। বলে যান, ‘‘ওটা আমাদের কাজ নয়, সাপ্লাই অফিসে খবর দিন।’’ একই ভাবে ১১ হাজার ভোল্টের তারে কোনও সমস্যা হলে এড়িয়ে যান ২২০/৪৪০ ভোল্টের মিস্ত্রিরাও। বিপদের সময় বিদ্যুৎ দফতরের আঞ্চলিক বা মহকুমা দফতরে যোগাযোগ করতে হিমসিম হতে হয় সাধারণ মানুষকে।

বিদ্যুৎ দফতর সূত্রে খবর, বণ্টন সংস্থার হাতে দায়িত্ব যাওয়ার পর কল-সেন্টারগুলি তুলে নেওয়া হয়। বন্ধ হয় সাব-ডিভিশনাল অফিসও। এখন সরাসরি সংশ্লিষ্ট সাপ্লাই অফিসের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকের বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগের কাজ করা হয়। স্থানীয় সাব-স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের আওতায় থাকা ঠিকাদার সংস্থা উচ্চ বিদ্যুৎপরিবাহী তার ও ট্রান্সফর্মারের কাজ করে। বিদ্যুৎকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, ওই দু’টি দফতরের মধ্যে কখনও সমম্বয়ের অভাব ঘটছে। তাতে ভোগান্তি বাড়ছে গ্রামে গ্রামে। বিদ্যুৎ দফতরের ওই কর্মীদের বক্তব্য, হাতুড়ে মিস্ত্রিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পারিশ্রমিকের বদলে জরুরি মেরামতির কাজ করানো হলে গ্রামে পরিষেবা আরও ভাল হতে পারে। গ্রাহকদের থেকে আদায় হওয়া ‘ইলেকট্রিসিটি ডিউটি’র টাকা থেকেই তাঁদের পারিশ্রমিকের সংস্থান হতে পারে।

বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ পরিষেবায় অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে ওই সব অভিযোগ নিয়ে বিদ্যুৎ দফতরের সঙ্গে কথা বলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement