কবে স্বাভাবিক হবে ছবি? মিড-ডে মিল নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে স্কুলে স্কুলে। —ফাইল চিত্র।
কোথাও রান্নাই বন্ধ। কোথাও হাজার হাজার টাকা ধার করে শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। অনেক জায়গায় রান্না হচ্ছে অন্য তহবিলের টাকায়।
সম্প্রতি মিড-মিল রান্নার এমন বেহাল ছবিই ধরা পড়েছে বোলপুর ব্লকের একটি বড় অংশের স্কুলে। যার পিছনে দীর্ঘ দিন ধরে অনুদান বন্ধ থাকাকেই দায়ী করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। মিড-মিল বন্ধ থাকায় স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতির হারও দিন দিন কমছে বলে প্রশাসনের কর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন। তার পরেও সমস্যার স্থায়ী সমাধানে প্রশাসন কোনও দিশা দেখাতে পারছে না বলেই অভিযোগ তুলছে বিভিন্ন স্কুল।
প্রশাসন সূত্রের খবর, ব্লকের একাধিক স্কুলে গত জানুয়ারি মাস থেকে মিড-ডে মিলের অনুদান বন্ধ আছে। কিছু স্কুলে চাল-সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক রসদ কিছুটা মজুত থাকায় সাময়িক অসুবিধা হয়নি। কিন্তু, তা দিয়ে বেশি দিন শেষরক্ষা করা যায়নি। মজুত শেষ হতেই বাধ্য হয়ে চালের আড়তদার এবং নটকোনা দোকানির কাছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ধার দেনা করতে হয়েছে। কিন্তু, স্বাভাবিক ভাবেই এক মাস গড়িয়ে টানা তিন মাস ধরে ধার চলায় টাকা না পেয়ে তারাও স্কুলকে মিড-ডে মিলের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগান দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ স্কুলের নিজস্ব তহবিল ভেঙে মিড-ডে মিল চালিয়েছেন। কিন্তু, সেই তহবিলও ফুরনোর মুখে। ফলে চাপের মুখে এলাকার বহু স্কুলই। শুধু বোলপুরই নয়, মিড-ডে মিল নিয়ে স্কুলের করুণ কাহিনির ছবি কম বেশি জেলার প্রতিটি ব্লকেই। এমনিতে প্রতি বছরই মাসখানেক ধরে প্রকল্পটি এ ভাবেই ধারে চালাতে হয় স্কুলগুলিকে। কিন্তু, এ বার শিক্ষা বর্ষের শুরুতেই এই সমস্যা হওয়ায় সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
এ রকমই একটি স্কুল বোলপুর শহরের নিম্ন বুনিয়াদী বালিকা বিদ্যালয়। ৫৫৮ জন পড়ুয়া রয়েছে। তাদের মধ্যে কমবেশি ৪০০ জনের জন্য মিড-ডে মিল বরাদ্দ রয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাক্ষীগোপাল মণ্ডল বলছেন, “সাড়ে ৯ কুইন্টাল মতো চালের দাম বকেয়া রয়েছে। আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবে আনুমানিক মোট ৩২ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে।’’ টাকা মেটাতে না পারায় ওই দোকানদার স্কুলের সঙ্গে লেনদেন একপ্রকার বন্ধই করে দিয়েছেন। তাঁর ক্ষোভ, “এই অবস্থায় কী ভাবে চালাবো বলতে পারেন? তাই উপায় না পেয়ে গত ১৮ এপ্রিল থেকে মিড-ডে মিল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি।”
শুধু পুরসভা এলাকাই নয়, এলাকার গ্রামের দিকের স্কুলের হাল কতকটা একই রকম। বোলপুর ব্লকের নাহিনা উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৪০০ জন পড়ুয়া মিড-ডে মিল খায়। প্রতি মাসে ইউসি (ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট) দেওয়ার সময় সমস্যার কথা এক বার করে ব্লক প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানান স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, অবস্থায়র কোনও পরিবর্তন হয় না। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অজয় রায় বলেন, “প্রত্যন্ত এলাকায় এই স্কুল। প্রায় ১২-১৩ কুইন্টাল চাল ধার হয়ে গিয়েছে। প্রায় তিন কুইন্টাল মতো কিনেছি। নটকোনা দোকানে ধার ২০ হাজারের কিছু বেশি। দেনার দায়ে দোকানদার মানিক দাসকে মুখ দেখাতে পর্যন্ত পারছি না।’’ এই প্রকিকূল অবস্থায় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে ওই স্কুলেও বন্ধ মিড-ডে মিল। অথচ স্কুলের ৫০ শতাংশ পড়ুয়াই তফশিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত। ৩৩ শতাংশ আসে সংখ্যালঘু নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। বাকি ১৭ শতাংশ পড়ুয়াই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। এ রকম সামাজিক এবং আর্থিক পরিবেশের মধ্যে থাকা একটি স্কুলে মিড-ডে মিল বন্ধ হওয়ার ফল মারাত্মক। দ্রুত হারে স্কুলে হাজিরা কমে যাচ্ছে। সে কথা অজয়বাবু স্বীকারও করে নিয়েছেন।
পাঁচশোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠে আবার কোনও রকমে জোড়াতালি মিড-ডে মিল প্রকল্প চলছে। তবে, অনুদান না পেলে ওই ভাবে বড়জোর আর দিন দু’য়েক স্কুলে হাড়ি চড়বে বলে জানিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সীতারাম মণ্ডল বলেন, “১০১৩ জন পড়ুয়ার মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করতে হয়। গত জানুয়ারি থেকে অনুদান বন্ধ। ব্লক প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। দ্রুত টাকা না এলে আর মাত্র দুই থেকে তিন দিন চালাতে পারবো।’’ তাঁর আশঙ্কা, ‘‘মিড-ডে মিল চালাতে গিয়ে যা ধারদেনা হয়ে গিয়েছে, তাতে যে কোনও দিন পাওনাদারেরা স্কুলে এসে ঝামেলা করতে পারেন!’’ একই অবস্থার কথা মেনে নিয়েছেন বাহিরী ব্রজ সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ মণ্ডলও।
সমস্যা সম্পর্কে অবগত বলে জানিয়েছেন বোলপুরের বিডিও শমীক পাণিগ্রাহী। তাঁর বক্তব্য, “অতিরিক্ত জেলা শাসক (উন্নয়ন)এবং জেলাশাসক সমস্যা মেটাতে ব্যবস্থা নিয়েছেন। আপাতত মিড-ডে মিলের এক মাসের বরাদ্দ এসে পড়েছে। আশা করছি আস্তে আস্তে অবস্থা স্বাভাবিক হবে। আর কোনও সমস্যা থাকবে না।” অন্য দিকে, জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী জানান, এফসিআই-এর মজুদ না থাকায় কিছু সমস্যা হয়েছিল। এফসিআই-এর সঙ্গে জেলা প্রশাসনের আলোচনাও হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আঞ্চলিক স্তরে আলোচনা করে সমস্যা মেটানোর জন্য বলা হয়েছে। তারা ইতিমধ্যেই সমস্যার সমাধানে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। আশা করছি চাল নিয়ে আর কোনও সমস্যা হবে না।”