মৃন্ময়ী: লাভপুরে প্রতিমা তৈরি করছেন তাপস মাঝি। নিজস্ব চিত্র
অর্থাভাবে নিজের কোনও দিন বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোনো হয়নি। কিন্তু, বিদ্যার দেবী গড়েই বিদ্যাকে বাড়িতে বেঁধেছেন তাপস মাঝি।
লাভপুরের পুরাতন কালুহা গ্রামে বছর পঞ্চাশের তাপসবাবুর অভাবের সংসার। বাবা প্রয়াত নিস্পতি মাঝি ছিলেন দিনমজুর। তাঁর আয়ের উপরেই নির্ভর করে চলত চার ভাই বোন সহ সাত সদস্যের সংসার। তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর হাল ছিল সংসারের। তাই অন্য ভাইবোনের মতো স্কুলে যাওয়া হয়নি তাপসবাবুর। নিজের ভাত নিজে জোগাড়ের তাগিদে তাঁকে অন্যের বাড়িতে গরু-ছাগল চড়ানোর কাজ নিতে হয়। মাঠে গরু চড়াতে চড়াতেই মাটি নিয়ে খেলাচ্ছলে পুতুল গড়া শুরু করেন সে দিনের সেই রাখাল বালক। ক্রমশ মূর্তি গড়ার নেশা চেপে বসে।
স্থানীয় দুই প্রতিমা শিল্পী নির্মল মাঝি এবং কাশীনাথ থান্দারের কাছে সহকারি হিসেবে হাতেখড়ি শুরু হয়। চোদ্দো বছর বয়েসে নিজে স্বাধীন ভাবে প্রথম তৈরি করেন গ্রামের সরস্বতী প্রতিমা। ২০ বছর বয়সে গ্রামেই তৈরি করেন প্রথম দুর্গা প্রতিমাও। সেই প্রতিমা আজও গড়ে চলেছেন তিনি। এখন অবশ্য সারা বছরই সব ধরণের প্রতিমা গড়েন। নিরক্ষর হলেও তাঁর তৈরি প্রতিমার চাহিদার কোনও কমতি নেই। বীরভূমের বিভিন্ন প্রান্ত তো বটেই, লাগোয়া বর্ধমানেও তাঁর তৈরি প্রতিমা বিভিন্ন মণ্ডপে পুজো হয়।
কান্দরার সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায়, ছোট্টু মণ্ডল, বগতোড়ের ফটিক মাঝিরা জানান, তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরেই তাপসবাবুর গড়া সরস্বতী প্রতিমায় পুজো করে আসছেন। সম্রাটের কথায়, ‘‘নিত্যনতুন শিল্পভাবনা দেখে মনেই হয় না উনি নিরক্ষর।’’ প্রতিমা গড়েই দুই ছেলেকে পড়াচ্ছেন তাপসবাবু। বড়ো ছেলে তন্ময় মাধ্যমিকে অকৃতকার্য হয়ে ফের পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর ছোটছেলে চিন্ময় একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। তারা বলে, ‘‘প্রতিমা গড়েই পড়াশোনা এবং সংসার চলে। অর্থাভাবে নিজে স্কুলে যেতে না পারার আক্ষেপ ছিল বাবার মধ্যে। আমরা সেই আক্ষেপ ঘোচানোর চেষ্টা করছি। বাবাকেও স্বাক্ষর করার চেষ্টা চালাচ্ছি।’’
নাতিদের পড়াশোনা নিজের ছেলেকে পড়াতে না পারার আক্ষেপ কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দিয়েছে তাপসবাবুর ৭৫ বছরের বিধবা মা খেমুদেবীকে। তিনি বলেন, ‘‘তখন তো সব দিন ভাতের হাঁড়িও চড়ত না। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাব কি করে? অন্য ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যেত, তখন আমার ছেলেমেয়েরা গরু-ছাগলের পাল নিয়ে মাঠে যেত। তা দেখে মনে মনে খুব কষ্ট হত। এখন নাতিদের যখন স্কুলে যেতে দেখি তখন সেই কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়।’’
আর তাপসবাবু বলছেন, ‘‘প্রথম দিকে ভরসা করে কেউ দুর্গা বা বড়ো বাজেটের প্রতিমার বায়না দিত না। সরস্বতী প্রতিমা নির্মাণই ছিল অন্যতম ভরসা। এখন ভগবান সহায় হয়েছেন।’’