লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের দিনেই হাতে রং-তুলি নিয়ে দেওয়াল লিখলেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। রবিবার শেষ বিকেলে বোলপুরের তৃণমূল কার্যালয়ের পাশের দেওয়ালে জোড়াফুল চিহ্নে রং ভরেন। তৃণমূলের তরফে এখনও প্রার্থীর নাম উল্লেখ করা হয়নি। প্রতীক-চিহ্ন এঁকে দেওয়াল রাঙানো হয়েছে মাত্র। প্রার্থী কে হচ্ছেন, এ নিয়ে জল্পনায় না গিয়ে অনুব্রত বলেন, ‘‘প্রার্থীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে পারবেন।’’ ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
প্রস্তুতি চলছিলই। রবিবার বিকেলে নির্বাচন কমিশন লোকসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পরেই কোমর কষে মাঠে নেমে পড়ার চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করে দিল শাসক এবং বিরোধী শিবিরের। আগে থেকেই ইতিউতি দেওয়াল লিখন চলছিল তৃণমূলের। এ ব্যাপারে তারা অনেকটাই এগিয়ে সিপিএম, বিজেপি-র চেয়ে। এ দিন ভোট ঘোষণার পরে বোলপুরে দেওয়াল লেখায় হাত লাগালেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও। এবং জানিয়ে দিলেন, ভোটে ‘পাঁচন’ ফর্মুলা শুরু হয়ে যাবে।
অনুব্রতের এই ঘোষণায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিরোধীরা। এমনিতে ভোটের ঢের আগেই বীরভূম ও বোলপুর কেন্দ্রে তাঁরা কত মার্জিনে জিতবেন, তা ঘোষণা করে দিয়েছেন অনুব্রত। ব্লকে ব্লকে সভা করে বুথ ও অঞ্চল সভাপতিদের তাঁদের এলাকা থেকে কত ‘লিড’ চাই তা-ও বলে দিচ্ছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি। তাঁর সেই ফরমান ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে জেলায়। বিরোধীরা বলছেন, জেলা সভাপতির বলে দেওয়া ‘লিড’ রাখার জন্য শাসকদলের নিচুতলার নেতা-কর্মীরা গা জোয়ারি করবেন, ভোটারদের ভয় দেখাবেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেটাই হয়েছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ। তবে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নজরদারিতে এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে ছবিটা এ বার বদলাবে বলেই তাঁদের আশা।
এপ্রিলের ১১ তারিখ থেকে ভোটগ্রহণ পর্ব শুরু। সাত দফায় ভোট। শেষ দফায় ভোটগ্রহণ ১৯ মে। ভোট গণনা ২৩ মে। এই জেলার দুই লোকসভা আসন বীরভূম ও বোলপুরে ভোটগ্রহণ হবে চতুর্থ দফায় অর্থাৎ, ২৯ এপ্রিল। এ রাজ্যে সাত দফায় নির্বাচন করানোর সিদ্ধান্তকে নিয়ে রাজ্যের মতো চর্চা শুরু হয়েছে বীরভূমের রাজনৈতিক মহলেও। বিরোধী দলগুলির কটাক্ষ, একটি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা ‘উদ্বেগজনক’ সেটা কমিশনের সিদ্ধান্তেই পরিষ্কার।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা বলছেন, ‘‘আমাদের দুর্ভাগ্য, আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ থাকায় সাত দফায় নির্বাচন করাতে হচ্ছে হচ্ছে এ রাজ্যে। ক্ষমতাসীন দল গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে এত প্রচারের পরও যে রাজ্যের প্রকৃত ছবিটা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নজর এড়ায়নি, এই সিদ্ধান্ত সেটাই প্রমাণ করে। আশা করি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করাতে সক্ষম হবে কমিশন। আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’’ প্রায় একই সুর বিজেপি-র জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায়ের গলায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিগত নির্বাচনগুলিতে বিশেষ করে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটের নামে যে প্রহসন হয়েছে, তা এ রাজ্যে সকলেই জানেন। সেই তথ্য অজানা ছিল না নির্বাচন কমিশনেরও। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, ভোট যুদ্ধে নামার জন্য সব রকম প্রস্তুতি তাঁরা শুরু করেছেন।
তবে বিচ্যুতি দেখলে প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে যেখানে অভিযোগ জানানো যায়, সেটা সেখানে জানানো হবে। রামকৃষ্ণবাবু বলেন, ‘‘নির্বাচনী বিধিভঙ্গ, ভয় দেখানো এবং মানুষকে ভোটদানে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে সেটা দ্রুত জেলা নির্বাচনী দফতর থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তৈরি রয়েছি। তৈরি ভোটদাতারাও। কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলের উন্নয়ন ঠেলে ভোট-ই দিতে পারেননি তাঁরা!’’
যদিও বিরোধীদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন জেলা তৃণমূলের শীর্ষ নেতা তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ মনগড়া যা কিছু বললেই সেটা মানতে হবে কে বলল! নির্বাচন কমিশন কিছু বলেছে কি? জাতীয় নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করারনোর জন্য যেটা ভাল বুঝেছে, তাই করেছে। এই নিয়ে কথা বলার কী মানে? নির্বাচনের জন্য তৈরি আমরাও।’’ তাঁর মতে, এখন রাজ্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের প্রচার মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়াটাই তাঁদের লক্ষ্য।
রাজনৈতিক দলগুলি এ বার কমিশনের দু’টি সিদ্ধান্তে খুশি। এক, ভোট গ্রহণের জন্য প্রতিটি বুথে ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট যন্ত্রের ব্যবহার। যা ভোট চুরি রুখবে বলেই মনে করছে প্রশাসন। ভোটার যে চিহ্নে ভোট দিলেন, সেখানেই তাঁর ভোট পড়ল কিনা, সেটা নিশ্চিত কববে এই ভিভিপ্যাট যন্ত্র। দুই, ‘সি-ভিজিল’ বা সিটিজেন ভিজিল্যান্স অ্যাপের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের যে কোনও ধরনের অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা। নিরপেক্ষ নির্বাচন সংগঠিত করার পথে কোনও ভাবে কোনও রাজনৈতিক দল বাধা হচ্ছে কিনা, বুথদখল, নগদ বিতরণ বা ভোটারদের প্রলুব্ধ করার জন্য কোনও দলের প্রার্থী বা তাঁর সমর্থকদের দ্বারা নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের কোনও ঘটনা সরাসরি নির্বাচন দফতরকে জানানো যাবে ওই অ্যাপের সাহায্যে। তার আগে অ্যাপ ডাউনলোড করে অভিযোগের সাপেক্ষে ছবি বা ভিডিও পাঠাতে হবে অ্যাপের মাধ্যমে। অভিযোগ পাওয়ার ১০০ মিনিটের মধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিরোধীরা বলছেন, কেমন হচ্ছে নির্বাচন, তা আগামী দিনে অভিযোগের বহর দেখলেই প্রমাণ হয়ে যাবে।