নিষিদ্ধ মাদকে ‘বুঁদ’ সীমানাঘেঁষা বসতি

ঝাঁ চকচকে বার বা পাব নেই, হাই প্রোফাইল মানুষের বাস নেই, তবু সন্ধ্যা নামলেই নলহাটির এ গ্রাম সে গ্রামের অন্ধকার পথে মাঝেমাঝে দামি গাড়ি বা মোটরবাইকে অপরিচিত কিছু মানুষকে যেতে দেখা যায়। স্থানীয়েরা জানান, ঝাড়খণ্ড থেকে আসা কিছু মাদকের কারবারি থাবা বসাতে চায় নিম্নবিত্ত চাষি পরিবারের কিশোর আর তরুণদের ভবিষ্যতে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নলহাটি শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০০:৫৮
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

রাজ্যের সীমানা ঘেঁষা অঞ্চল চিরকালই পাখির চোখ মাদক কারবারিদের। পুলিশের বক্তব্য, স্থানীয় বাসিন্দাদের নেশায় আসক্ত করে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে মাদক পাচারের সহজ উপায়কে কাজে লাগানোটা পুরনো পন্থা পাচারকারীদের। সীমানাবর্তী এলাকাগুলিকে ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ তৈরির কথা জানেন পুলিশ, আবগারি বা নারকোটিক কন্ট্রোল ব্যুরোর আধিকারিকেরা। এ রাজ্যের সীমানা ঘেঁষা বীরভূমের নলহাটিও সেই ‘ট্রানজিট পয়েন্টে’র একটি। মাঝেমধ্যে রুটিন তল্লাশি অভিযান চললেও নেশার বীজ যে কতদূর ছড়িয়েছে তা স্পষ্ট হল শনিবার ভোরে নেশাগ্রস্ত ভাইয়ের হাতে উনিশ বছরের এক তরুণের খুন হওয়ার ঘটনায়।

Advertisement

ঝাঁ চকচকে বার বা পাব নেই, হাই প্রোফাইল মানুষের বাস নেই, তবু সন্ধ্যা নামলেই নলহাটির এ গ্রাম সে গ্রামের অন্ধকার পথে মাঝেমাঝে দামি গাড়ি বা মোটরবাইকে অপরিচিত কিছু মানুষকে যেতে দেখা যায়। স্থানীয়েরা জানান, ঝাড়খণ্ড থেকে আসা কিছু মাদকের কারবারি থাবা বসাতে চায় নিম্নবিত্ত চাষি পরিবারের কিশোর আর তরুণদের ভবিষ্যতে। ফসলের খেতে, স্কুলের মাঠে সর্বত্র ব্রাউন সুগার, চরস, গাঁজা, হেরোইন, স্পাইক নানা রকমের মাদকের আসর বসে নিত্যদিন। গ্রামগুলির বিভিন্ন পাড়ায় মহিলা, বৃদ্ধেরা এতদিন চুপ করে থাকলেও এখন প্রতিবাদে মিছিল করেন। সচেতনতা বাড়াতে মিটিং করেন। ‘‘কিন্তু মাদকের জাল ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের অনেক গভীরে’’ বলেন, সুজাতা মণ্ডল নামে এক প্রৌঢ়া।

মাদকের কারবারের শিকড় যে এই এলাকার অনেকটা গভীরে চলে গিয়েছে তার প্রমাণ মেলে নলহাটির রাম মন্দির, বাসস্ট্যাণ্ড, সাহেব বাগান মাঠ, স্টেশনের কাছাকাছি পথে ঘাটে ঘুরলেই। পান, বিড়ির ছোটখাটো দোকানগুলোতে দশ টাকা দিয়ে ‘বাবা’ চাইলেই গাঁজা সিগারেটের খোলে ভরা গাঁজা পাওয়া যায়। ব্রাউন সুগার পাওয়া যায় ‘গরদ’ নামে। কারবারিদের হাত ঘুরে তিনশ থেকে চারশ টাকা দামের একেক পুরিয়া খোলা বাজারে বিক্রি হয় পাঁচশ থেকে আটশ টাকা দামে। তবে এই পুরিয়া নিদির্ষ্ট কোনও ঠেকে বিক্রি হয় না। নেশাড়ুরা জানেন, ‘গরদে’র অর্ডার কাকে কোথায় দিতে হয়। ক্যুরিয়ার সার্ভিস বা হোম ডেলিভারির মতো পরিষেবা মেলে ব্রাউন সুগারের। একই ভাবে মেলে চরস। যার এই অঞ্চলে প্রচলিত নাম ‘আঠা’ বা ‘গঁদের আঠা’। ‘আঠা’র নেশায় বুঁদ যুবকদের একটা বড় অংশ এমনটাই দাবি এলাকাবাসীর।

Advertisement

সূত্রের খবর, সড়ক পথের পাশাপাশি নিষিদ্ধ মাদক নলহাটিতে রেল পথেও আসে। উত্তরবঙ্গ থেকে আসা রাতের বিভিন্ন ট্রেন থেকে নামে নিষিদ্ধ মাদকের প্যাকেট।। জগধারী রেল সেতু থেকে করিমপুর রেলগেট পর্যন্ত চরস পাচারকারীদের ‘ওপেন করিডর’ বলে জানান স্থানীয়েরা। জগধারী শ্মশান, করিমপুর রেলগেট সংলগ্ন বিভিন্ন দোকানে নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে চরস এবং গাঁজা বিক্রি হয় বলে অভিযোগ।

সস্তায় পাওয়া ইঞ্জেকশন, ডেনড্রাইট। নেশাড়ুদের আড্ডা নলহাটি পুরনো হাসপাতালের মাঠ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ এলাকাবাসীর। বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন, ‘‘মাঠ কি আর মাঠ আছে। নেশাখোরদের আস্তানা। কেবল রাতে নয়, দিনে-দুপুরে মদ-গাঁজার ঠেক বসে। সন্ধ্যা নামলে আর ওই এলাকা দিয়ে যাওয়া যায় না। নেয়েদের নিরাপত্তার দিকটাও তো প্রশাসনের একবার ভাবা দরকার।’’ একই ছবি নলহাটি পাহাড় এলাকায়। সেখানে বর্গিডাঙার মাঠে গিয়ে দেখা মিলল ডেনড্রাইটের খাপ, খালি টিউব, মাদকের পুরিয়া আর মদের খালি বোতলের। স্থানীয়েরা জানান, বর্গিডাঙা এলাকা, মাজার ও মন্দিরের কাছাকাছি, বিডিও অফিস যাওয়ার রাস্তার ধারে ঝোপে জঙ্গলে নিষিদ্ধ মাদকের ঠেক নিয়মিত বসে। শহরের নেশার আরেকটি বড় ঠেক হরিপ্রসাদ হাইস্কুল মাঠ। সন্ধ্যা থেকে ঠেক জমজমাট, চলে গভীর রাত পর্যন্ত এমনটাই অভিযোগ ওই এলাকার বাসিন্দাদের।

নলহাটি পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একরামুল হক বলেন, ‘‘নলহাটি শহরের বিভিন্ন এলাকায় স্পাইক, গাঁজা, চরস, ডেনড্রাইট ও ব্রাউন সুগারে ছেয়ে গিয়েছে। এই সব নেশার ফলে যুবসমাজ, গরীব মানুষদের একাংশ দিন দিন আর্থিক সঙ্গতি হারাচ্ছে ও শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। সংসারে অশান্তি হচ্ছে। যার পরিণতি, ভাই ভাইকে খুন করল।’’ তাঁর দাবি, ‘‘এলাকার অনেক ছেলেকে নেশা মুক্তি সেন্টারে ভর্তি করেছি। কিন্তু যে ভাবে নিষিদ্ধ মাদকের বাড়বাড়ন্ত তাতে আমরা চিন্তিত। প্রশাসন ধরপাকড় করছে ঠিকই কিন্তু জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার আর্জি, প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ করুক, নইলে এই এলাকার তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’’

নারকোটিক কন্ট্রোল ব্যুরোর এক প্রাক্তন কর্তার কথায়, ‘‘প্রতি বছর গোটা বিশ্বে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মাদকের ব্যবসা হয়। এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মাথা স্থানীয় একজন মাদক পাচারকারীর প্রতি বছরের আয় হয় তিনশ কোটি টাকা। প্রতিটি রাজ্যেই সীমানাবর্তী এলাকায় ব্যবসা চালানোর জন্য আন্তঃরাজ্য চক্র কাজ করে।’’ কিন্তু প্রশ্ন এখানেই। এটা যখন সংশ্লিষ্ট মহল জানে তারপরেও কেন ফাঁক থেকে যায়? বীরভূমের আবগারি বিভাগের সুপারিন্টেন্ডেন্ট বাসুদেব সরকার বলেন, ‘‘কখনও একক ভাবে কখনও আবার পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ মাদক ও চোলাই মদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি আমরা। নলহাটির বিভিন্ন গ্রামে মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা শিবির, কেবল টিভি ও রেডিওতে প্রচার চালানো হয়। কিন্তু তার পরেও যথেষ্ট সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। আরও প্রচারের দরকার, আরও অভিযানের প্রয়োজন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement