সব বাধা পেরিয়ে। প্যাটেলনগরে প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে ঘুড়ি-লাটাই হাতে মহিলারাও। —নিজস্ব চিত্র।
সাঁ করে কাইট রাইডারের প্রতিযোগীর কান ঘেঁষে চলে গেল কাইট চ্যালেঞ্জারের প্রতিযোগী। পরক্ষণেই তার ঘাড়ের কাছে চলে এল সৃজনী ফাইটারের প্রতিযোগী। কোনও প্রতিযোগী আবার হেলতে-দুলতে বাতাসে ভাসতে ভাসতে মাটিতে নেমে এল। মাটিতে তখন এক দঙ্গল মানুষ লাটাই হাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সুতো ধরে কারিকুরি চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিশ্বকর্মা পুজোয় শুক্রবার মহম্মদবাজার থানার প্যাটেলনগরের মডেল স্কুল মাঠে এই ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতায় মাতলেন বিভিন্ন বয়সের মানুষজন। আয়োজন করেছিল স্থানীয় ‘আঙারগড়িয়া সৃজনি শিক্ষানিকেতন’ নামে একটি সংস্থা। সকাল ১১টা নাগাদ ঘুড়ি ওড়ানোর এই প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন নাবার্ডের ডিস্ট্রিক্ট ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার সুমর্ত ঘোষ।
মহম্মদবাজার ব্লক ছাড়াও জেলার বিভিন্ন ব্লক নলহাটি ২, রাজনগর, বোলপুর, সাঁইথিয়া, সিউড়ি-১, ময়ূরেশ্বর ১ ব্লক থেকেও অনেক প্রতিযোগী এসেছিলেন। সারা জেলা থেকে মোট ১৬টি দল প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়। প্রতি দলে চার জন করে সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যেমন ৫৮ বছরের প্রৌঢ় ছিলেন, তেমনই কলেজ পড়ুয়া থেকে দিন মজুরও ছিলেন। উল্লেখ্য এই প্রতিযোগীতায় ৩০ জনের বেশি মহিলা প্রতিযোগীও ছিলেন। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দলগুলির নামও ছিল আকর্ষণীয়। কোনও দলের নাম ‘কাইট রাইডার’ তো কোনও দলের নাম ‘কাইট চ্যালেঞ্জার’। কোনও দল ‘সৃজনী গ্রিন’ তো কারোও নাম ‘সৃজনী ফাইটার’।
সকাল ৯টা থেকেই প্যাটেলনগরের মডেল স্কুল মাঠে আসতে শুরু করেছিলেন প্রতিযোগীরা। রোদের হাত থেকে বাঁচতে মাঠের ধারে গাছের তলায় বসে যে যার ঘুড়ি ওড়ানোর সরঞ্জাম ঠিক করতে বসে ছিলেন। কেউ লাটাইয়ের সুতোর মাঞ্জা পরীক্ষা করছিলেন, কেউ ঘুড়িতে যুক্তি বাঁধছিলেন। কেউবা ঘুড়ির পিছনে পুরনো খবরের কাগজ দিয়ে ঘুড়ির লেজ তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এই ভাদ্র মাসের রোদে যাতে কারও কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য আয়োজক সংস্থা আগে থেকেই মাঠের এক কোণে একটি টেবিলে সবার জন্য রেখে দিয়েছে মিনারেল ওয়াটার আর পানীয়।
বেলা ১১টা বাজতেই এক এক করে সব দলগুলিকে ডেকে নেন আয়োজকরা। এর পর প্রত্যেক দলের সবার হাতে জলের বোতল ধরিয়ে দিয়ে শুরু করে দেন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা। তা চলল প্রায় সারা দুপুর ধরেই। ঘুড়ি ওড়ানোর নিয়মাবলিও ছিল অনেক। যেমন প্রতি দলকে ন্যূনতম ১০ থেকে ১৫ মিনিট আকাশে ঘুড়ি রাখতে হবে। ঘুড়ি কাটতে পারলে ১ পয়েন্ট পাওয়া যাবে। কেটে যাওয়া ঘুড়ি আকাশ থেকে নামাতে পারলে ৩ পয়েন্ট পাওয়া যাবে। কোনও দেশের জাতীয় পতাকার অনুকরণে তৈরি ঘুড়ি ওড়নো যাবে না। তবে কোনও দল যদি তথাকথিত ঘুড়ির বাইরে নতুন ধরনের কোনও ঘুড়ি বা অন্য কোনও বিদেশি ডিজাইনের ঘুড়ি ওড়ায় তবে ১০ পয়েন্ট পাবে।
নলহাটির ভদ্রপুর থেকে এসেছিলেন ৫৮ বছরের বন্ধুগোপাল মণ্ডল। তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন মল্লারপুর সংলগ্ন গোয়ালা গ্রামের বাসিন্দা পেশায় দিনমজুর পঞ্চানন দাস, আদিত্য দাসরা। আবার বিদ্যাসাগর কলেজের কলা বিভাগের ছাত্র প্রহ্লাদ সাহা, অর্জুন দাসদের সাথে প্রতিযোগিতায় পাশাপাশি মাঠে নেমেছে ফুল্লাইপুরের গৃহবধু ঝুমা মণ্ডল, আসেঙ্গার বনশ্রী ভট্টাচার্য, মহম্মদবাজারের চন্দনা দাস, মৌসুমী অধিকারীরা। সবার বক্তব্য একই— ‘‘বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দই আলাদা। তাই এই সুযোগ পেয়ে আমরা আর তা ছাড়তে রাজি হয়নি।’’
আয়োজক সংস্থা ‘আঙারগড়িয়া সৃজনী শিক্ষানিকেতন’-এর যুগ্মসভাপতি পূর্ণেন্দু গড়াই ও সেক্রেটারি বিকাশকুমার মণ্ডল বলেন, ‘‘এখনকার প্রজন্মের ছেলেরা ঘুড়ি ওড়ানো, গুলি খেলা এই সব খেলা আর খেলে না। ওই সব পুরনো খেলাগুলি সমাজে আবার নতুন করে যাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তার জন্যই আমাদের এই প্রয়াস।’’
উদ্বোধন করেই থেমে থাকেননি উদ্বোধক। যিনি ঘুড়ি উড়িয়ে এই প্রতিযোগীতার উদ্বোধন করেছিলেন তিনি প্রতিযোগীতা শুরু হওয়ার আধ ঘণ্টা পরেও তাঁকে দেখা গেল মাঝ মাঠের মধ্যে তিনি ঘুড়ি ওড়ানোতে ব্যস্ত। পরে আয়োজক সংস্থার কাজ থেকে জানা গেল তিনিও প্রতিযোগী হিসাবে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। উদ্বোধক তথা অন্যতম প্রতিযোগী নাবার্ডের ডিস্ট্রিক্ট ডেভলপমেন্ট ম্যানেজার সুমর্ত ঘোষ বলেন, ‘‘হারি জিতি সেটা বড় কথা নয়, এই ঘুড়ির টানই আলাদা। আর ওঁরা যে আবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সেটাই বা কম কি! একরাস আনন্দ পাচ্ছি।’’
প্রতিযোগিতার শেষে বিচারকদের সিদ্ধান্তে প্রথম হয় ‘সৃজনী রেডিস’ দলের প্রিয়ম ওঝা, বীথিকা দাস, পাপিয়া গড়াই ও সুখেন মারান্ডি। আয়োজক সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের হাতে ১০০০ টাকা ও একটি মোমেন্টো তুলে দেওয়া হয়।