চড়া দরেই আলু-বীজ কিনে চাষ বিষ্ণুপুরের ভাটরা গ্রামে। নিজস্ব চিত্র।
সময় চলে যাচ্ছে, জমিও তৈরি। কিন্তু আলু চাষ শুরু হচ্ছে না। লাফিয়ে বাড়ছে বীজ-আলুর দাম। গত বছরে যা পাওয়া যাচ্ছিল ১,৬০০ টাকায় পঞ্চাশ কেজি, এ বার তারই দর হয়েছে ৪,৯০০ টাকা।
কেন এই পরিস্থিতি? বিষ্ণুপুরের বাঁকাদহের এক বিক্রেতার দাবি, করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে, এ বছর পঞ্জাবে বীজ-আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘পঞ্জাবের বেশি বীজ গুজরাত আর কর্নাটকে চলে গিয়েছে। সেখানে জলদি আলু চাষের মরসুম আরও আগে শুরু হয়ে যায়। এতে বাংলায় জোগানে টান পড়েছে।’’ বাঁকুড়া জেলার কৃষি অধিকর্তা সুশান্ত মহাপাত্র জানাচ্ছেন, গত কয়েকবছর চাষিরা ভাল দাম পাওয়ায় এ বছর প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি জমিতে জলদি আলুর চাষ হচ্ছে। ফলে, জোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি দাঁড়িয়েছে। সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘বীজ-আলু ভিন্-রাজ্য থেকে আসে। পরিবহণে সমস্যা আছে। তবে কিছু ব্যবসায়ীও অসাধু কারবার করছেন।’’ তিনি জানান, আইন অনুযায়ী বীজের দাম নিয়ন্ত্রণের কোনও পথ কৃষি দফতরের নেই। পরিস্থিতি উপরে নজর রেখে জেলাশাসক ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।
রবি মরসুমের ৬০ থেকে ৭৫ দিনের মধ্যে জলদি আলু চাষ হয়ে যায়। চলতি বছরে আবহওয়া এখনও পর্যন্ত এই চাষের পক্ষে সহায়ক বলে জানাছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা জানান, কার্তিকের প্রথম সপ্তাহে জোরকদমে শুরু হয় জলদি আলুর চাষ। পৌষের শুরু বা মাঝামাঝি সময় থেকে বিক্রি শুরু হয়ে যায়। বিষ্ণুপুরের আমডহরার ইননাদ খান ও বিদ্যাসাগর গ্রামের গৌড় শীটরা বলেন, ‘‘হাতে নগদ টাকা নেই। এ দিকে, বীজের দাম প্রতি দিন বেড়ে চলেছে। বাধ্য হয়ে মহাজনের ফাঁদে পা দিতে হচ্ছে।’’ সোনামুখীর তেলরুই গ্রামের চাষি নিত্যানন্দ দেবনাথ জানান, জলদি আলুতে আগ্রহ বেড়েছে গত বছর দশেকে। এই আলু হিমঘরে রাখা যায় না, খোলা বাজারে বিক্রি করতে হয়। নগদে ভাল দাম মেলে। কামারপাড়া গ্রামের সাহেব মুর্মু ও চাঁচর গ্রামের উত্তম দে বলেন, ‘‘বীজ-আলুর এত দাম আগে দিতে হয়নি। বাজারে এই আলু এলে তার দামও বেশি হবে।’’
চাষিরা জানাচ্ছেন, সাধারণত এক বিঘা জমিতে জলদি আলু চাষের জন্য বীজ, সার, কীটনাশক, জল— সব মিলিয়ে গত বছর ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। সচরাচর এক বিঘা জমি থেকে ২৫ কুইন্টাল আলু মেলে। গত বছর দলদি আলু মরসুমের গোড়ায় ২,৫০০ টাকা কুইন্টাল ও শেষে ১,০০০ টাকা কুইন্টাল দরে বিক্রি হয়েছে। এ বার খরচের তুলনায় দাম কেমন মিলবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সংশয় দেখা দিচ্ছে। কোতুলপুরের চাষি বিকাশ পান ও জয়পুরের খোকন লোহার বলেন, ‘‘এক বিঘা জমিতে জলদি আলু চাষের জন্য প্রয়োজন প্রায় দু’কুইন্টাল বীজ। তা কিনতে ২০ হাজার টাকা, খরচ হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ৫০ কেজির বস্তা কিনে দেখছি বীজ আছে ৪৫ কেজি। তার মধ্যে আবার তিন কেজি খারাপ।’’ সোনামুখীর নবাসনের চাষি নিতাই গড়াইয়ের কথায়, ‘‘এত খরচ করে চাষ সম্ভব নয়। গত বার ধসা রোগে ক্ষতি হল। ক্ষতিপূরণ হাতে এল না। বিমার টাকা ঋণের কিস্তিতেই চলে গেল।’’
সমবায়ের মাধ্যমে বীজ বিক্রির ব্যাপারে উদ্যোগের অভাব এবং অন্য রাজ্যে আলু বিক্রির জায়গাগুলিতে সরকারি নজরদারির যথেষ্ট না হওয়ায় এই পরিস্থিতি বলে মনে করছেন চাষিদের একাংশ। কৃষকসভার বাঁকুড়া জেলা সভাপতি ষড়ানন পাণ্ডে বলেন, ‘‘সমবায়গুলিতে নির্বাচন হয় না। সেগুলি অচল হয়ে গিয়েছে। আর ফল ভুগতে হচ্ছে চাষিদের।’’ তাঁর অভিযোগ, বীজের কালো বাজারি নিয়ে অনেক বার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কোনও পদক্ষেপ হয়নি। বাঁকুড়া জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা বলেন, ‘‘অভিযোগ ঠিক নয়। নজরদারি আছে। আরও বাড়ানো হবে।’’ নিজেদেরর রাজ্যের বীজ ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।
জেলার কৃষি-কর্তারা দাবি করেছেন, বীজ-আলু তৈরিতে এখানকার চাষিরাই উৎসাহ দেখান না। তার উপরে বীজ সংরক্ষণের হিমঘরও নেই জেলায়। নভেম্বরের শুরুতে জয়পুর এবং জয়রামবাটির বীজঘর থেকে জ্যোতি ও চন্দ্রমুখী আলুর বীজ ৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে কৃষি দফতর।