নোংরা চত্বর দেখে তাজ্জব স্বাস্থ্য সচিব। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
রাতারাতি ছবিটা পাল্টে গিয়েছিল। চার দিকে ব্লিচিং পাউডারের ঝাঁঝালো গন্ধ। ঝাকঝক করছে হাসপাতালের মেঝে। সাফাই কর্মীদের ঝাড়ুও থামেনি দিনভর। এত কিছুর পরেও ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা গেল না’। রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব অনিল বর্মার নজরে বাঁকুড়া মেডিক্যালের আসল ছবি বেআব্রু হয়ে পড়ল।
পরিদর্শন করতে এসে কোথাও তিনি দেখলেন, হাসপাতাল চত্বরেই জমে রয়েছে প্রস্রাব। কোথাও আবার ঝুলছে বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। সব মিলিয়ে অস্বস্তি পিছু ছাড়েনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
বাঁকুড়া মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের ঠিক উল্টো দিকেই বাঁকুড়া পুরসভার উদ্যোগে সৌন্দর্যায়নের কাজ শুরু হয়েছে। বাঁকুড়ার পুরপ্রধান মহাপ্রসাদ সেনগুপ্ত স্বাস্থ্য সচিবকে সেই কাজ দেখাতে নিয়ে যান। কিন্তু সেই জায়গার পাশেই খোলা জায়গায় সাধারণ মানুষ প্রাকৃতিক কাজ সারেন। দুর্গন্ধ পেয়ে স্বাস্থ্য সচিব ও কর্তারা নাক কোঁচকান। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, পাইপ ফেটে এলাকা জলমগ্ন হচ্ছে। শীঘ্রই সেই ভুল ভেঙে যায়। ওই এলাকায় শৌচকর্ম করা হয় শুনে কেন এলাকাটি পরিষ্কার করা হয় না, তা জানতে চান স্বাস্থ্য সচিব। পুরপ্রধান সদুত্তর দিতে পারেননি। ওই এলাকাতেই দু’টি জায়গায় বেসরকারি অস্থি-শল্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হোর্ডিং দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য সচিব। হাসপাতালের কর্তাদের কাছে তিনি কৈফিয়ৎ চান। যদিও হাসপাতালের কর্তারাও সদুত্তর দিতে পারেননি।
বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, হাসপাতাল পরিদর্শনের আগে এ দিন বাঁকুড়া মেডিক্যালের নতুন ভবনে বৈঠকেও স্বাস্থ্য সচিব হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি তুলে পুরসভাকে সচেতন করেছিলেন। যাতে হাসপাতালের নিকাশি নালা নিয়মিত সাফ করা হয়, পুরসভাকে সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
দায়িত্ব নেওয়ার পরে স্বাস্থ্য সচিব প্রথম বাঁকুড়ায় এলেন। পরিদর্শনের প্রস্তুতি দেখতে বুধবারই হাসপাতালে যান জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু। বৃহস্পতিবার হাসপাতালের দেওয়াল ঘেঁষে থাকা সারি সারি অবৈধ ঝুপড়ি উচ্ছেদ করে প্রশাসন। হাসপাতাল চত্বর থেকে ওয়ার্ডেও সে ভাবে নোংরা জমে থাকতে দেখা যায়নি। সব দেখে অনেকেই বলছেন, কেন্দ্রের স্বাস্থ্য-দল সফরে এলে এই ধরনের ‘কনে সাজানো’র পরিস্থিতি হয়। রাজ্যের কোনও কর্তার জন্য এমন তৎপরতা কে কবে দেখেছেন? তবে সূত্রের খবর, সম্প্রতি রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব বিভিন্ন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করে নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন। তারপর থেকেই কিছু জেলার স্বাস্থ্য কর্তারা কার্যত সিঁটিয়ে রয়েছেন। তটস্থ জেলা প্রশাসনও।
বাঁকুড়া মেডিক্যালের স্ত্রী ও প্রসূতি বিভাগের রোগীর আত্মীয় বাঁকুড়া সদর থানার ভেদুয়া গ্রামের বাসিন্দা বিকাশ মাল, বেলিয়াতোড়ের বেলবনির বাসিন্দা অভিজিৎ মণ্ডলরা বলেন, ‘‘এক রাতেই হাসপাতালের ভোল বদলে গিয়েছে। রাত থেকেই দেখছি ঘন ঘন ঝাঁট পড়ছে ওয়ার্ডে। গোটা হাসপাতাল জুড়েই চলছে সাফাই অভিযান। চিকিৎসকেরাও আসছেন সময় মতো ইউনিফর্ম পরে আসছেন। মাসে একবার করে স্বাস্থ্য-কর্তাদের পা পড়লে রোগী ও তাঁদের পরিজনদের দুর্ভোগ অনেক কমে যাবে।’’
বৃহস্পতিবার রাতেই জেলায় এসে প্রথমে বড়জোড়া সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্য সচিব। এ দিন সকালে তিনি ছাতনা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে বাঁকুড়া মেডিক্যালে আসেন তিনি। মেডিক্যাল পরিদর্শন করে তিনি জেলার আরও দুই সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ওন্দা ও বিষ্ণুপুর পরিদর্শনে যান।
বিষ্ণুপুরে সাফাইয়ের কাজ চলার জন্য রোগীর আত্মীয়দের ‘ভিজি়টিং আওয়ারে’ বেলা ১২টার পর ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তা নিয়ে ক্ষোভ ছড়ায়। বিকেল পাঁচটায় স্বাস্থ্য সচিব পরিদর্শনে আসার কিছু আগেই রোগীর পরিজনদের চাপে তাঁদের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ঢুকেই স্বাস্থ্য সচিব রোগী সহায়তা কেন্দ্রের খোঁজ করেন। কিন্তু সুপার পৃথ্বীশ আকুলি ‘রোগী সহায়তা কেন্দ্র নেই’ জানাতেই, স্বাস্থ্য-সচিব বলেন, ‘‘থাকা উচিত ছিল’। সুপার তাঁকে জানান, পাশের বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে ওই কেন্দ্র রয়েছে। সেখানেই সব কাজ হয়ে যায়।
সূত্রের খবর, বাঁকুড়া মেডিক্যালে বৈঠকে স্বাস্থ্য সচিব সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল থেকে রোগীদের স্থানান্তর করা কমাতে, ওই হাসপাতালগুলির চিকিৎসকদের বাঁকুড়া মেডিক্যালে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী দু’মাসের মধ্যে তা শেষ করতে বলেছেন।
যদিও বাঁকুড়া মেডিক্যালের বহু চিকিৎসককে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালগুলিতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে আখেরে বাঁকুড়া মেডিক্যালের পরিকাঠামোই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে মুখ্য সচিবের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।