ছবি- এ এফ পি
শংসিত বীজ উৎপাদনে বীরভূম জেলাকে অগ্রগণ্য করা লক্ষ্য কৃষি দফতরের। তাতে এ বার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে চলেছে জেলার কয়েকটি সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি (এসকেইউএস)।
সমবায় ও কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দু’টি দফতরের উদ্যোগে জেলায় পাঁচটি এসকেইউএস ইতিমধ্যেই সেই কাজে হাত দিয়েছে। আর্দ্রতামুক্ত, উন্নতমানের বাছাই করা শংসিত বীজ পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্যে ‘প্রসেসিং ইউনিট’ বসেছে। তালিকায় রয়েছে রাজনগরের শ্রীমাধব, লাভপুরের মিরিটি ব্রাহ্মণপাড়া, সিউড়ি ২ ব্লকের তেঘড়িয়া ও নলহাটি ১ ব্লকের কৈথা ও সুলতানপুর সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিগুলি।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, তালিকাভূক্ত সমবায়গুলি ইতিমধ্যেই বীজ নিগম থেকে শংসিত বীজ বিক্রির ছাড়পত্র পেয়েছে। চলতি বছর থেকেই উৎপাদন শুরু হয়েছে।
জেলা সমবায় সমিতি সমূহের উপ-নিয়ামক কৃষ্ণকান্ত সরকার ও জেলা সহ-কৃষি অধিকর্তা (সিড সার্টিফিকেশন) সুখেন্দুবিকাশ সাহা বলছেন, ‘‘সফল ভাবে কৃষি সমবায়গুলি বীজ উৎপাদন শুরু করলে জেলার কয়েক হাজার চাষি উপকৃত হবেন।’’ একই মত সমবায়গুলির সম্পাদক, ম্যানেজার ও স্থানীয় চাষিদের।
কৃষ্ণকান্তবাবুর সংযোজন, প্রতিটি কৃষি সমবায়ের সদস্য সেই এলাকার হাজারখানেক চাষি। তাঁদের দিয়ে শংসিত বীজ উৎপাদন করিয়ে তা বিক্রি করা হয়। তাতে দু’দিন থেকে লাভ। প্রথমত, চাষি বীজ উৎপাদনের জন্য বেশি দাম পাবেন। দুই, অনেক কম দামে সঠিক গুণমানের বীজ
পেয়ে যাবেন।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সিউড়িতে একটি অনুষ্ঠানে বীজ নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রদীপ মণ্ডলের বক্তব্য ছিল, ‘‘আমাদের রাজ্যের চাষিদের প্রধান সমস্যা হল, ভাল মানের বীজ না পাওয়া। ৩০ শতাংশ কাজ এগিয়ে যায়, যদি চাষি সঠিক মানের বীজ পান।’’ কৃষিকর্তাদের মতে— আবহাওয়া, মাটি ও পরিবেশের নিরিখে বীরভূম বীজ উৎপাদনের জন্য একটি
উপযুক্ত জায়গা।
কৃষিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘জেলার সেই পরিবেশকে কাজ লাগিয়ে আগামী দিনে কী ভাবে শংসিত বীজ উৎপাদনে অগ্রগণ্য হওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। সমবায়ের মাধ্যমে সংশিত বীজ উৎপাদনের ভাবনা তারই অঙ্গ।’’
জেলা সমবায় দফতর সূত্রে খবর, জেলার শতাধিক কৃষি সমবায় এমনিতেই চাষিদের শংসিত
বীজ বিক্রি করে। কিন্তু সমবায়ের কৃষক সদস্যদের দিয়ে উন্নতমানের বীজ উৎপাদন করানো এবং শংসিত সেই বীজ বিক্রি করার ছাড়পত্র বা পরিকাঠামো পাওয়া এই প্রথম।
প্রশাসন জানিয়েছে, ওই কাজ প্রথম শুরু করেছিল লাভপুরের মিরিটি ব্রাহ্মণপাড়া কৃষি সমবায়। ‘সিড গ্রেডার’ ও প্রসেসার-সহ বিভিন্ন যন্ত্র লাগিয়ে ২০১১ সাল থেকে ওই উদ্যোগ নিলেও, বীজ নিগম থেকে শংসিত বীজ বিক্রির ছাড়পত্র মেলে ২০১৭ সালে। অন্য দিকে, বাকি যে চারটি কৃষি সমবায়ে রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা প্রকল্পের অর্থসাহায্যে (কমবেশি ৩৫ লক্ষ টাকা) প্রসেসিং ইউনিট লেগেছে।
দু’টি দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, জেলায় এসে বিভিন্ন এজেন্সি চাষিদের দিয়ে বীজ উৎপাদন করিয়ে নিয়ে যায়। যে কৃষি সমবায় সমিতির সঙ্গে এত সংখ্যক চাষি যুক্ত, উপযুক্ত পরিকাঠামো পেলে তা কেন করা যাবে না। তার পরেই প্রকল্প গড়ে ভাবনা বাস্তবায়িত করার পদক্ষেপ করা হয়।
এই উদ্যোগকে কী ভাবে দেখছেন কৃষি সমবায় কর্তৃপক্ষ ও চাষিরা?
মিরিটি ব্রাহ্মণপাড়া সমবায়ের ম্যানেজার পঞ্চানন মণ্ডল বলছেন, ‘‘আমাদের সমবায়ের সদস্য হাজারখানেক। বীজ উৎপাদন শুরু হওয়ার পরে ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে। লাইসেন্স পাওয়ার পরে আরও সুবিধা হবে। আগে ধান বীজ উৎপাদন করা হতো। এ বার সর্ষে, মুসুর, ছোলা বীজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।’’ বীজ উৎপাদন করে বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ ও হাতের লাগালে বীজের জোগান পেয়ে খুশি এলাকার চাষি বিবেকানন্দ মণ্ডল ও যাদব দে।
এমনিতে বীজ উৎপাদন করার পদ্ধতি হল, কৃষি বিজ্ঞানী বা সরকার অনুমোদিত সংস্থা থেকে উন্নতমানের বীজ (বিডার) কিনতে হয়। শর্ত মেনে চাষ করলে তা থেকে অনেক বেশি পরিমাণে বীজ পাওয়া যায়। যাকে ফাউন্ডেশন বলে। শংসিত বীজ উৎপাদনের জন্য সেই ‘ফাউন্ডেশন সিড’ ব্যবহৃত হয়।
রাজনগর এসকেইউএসের ম্যানেজার তুলসীদাস মণ্ডল বলেন, ‘‘গত বারই যন্ত্রপাতি বসেছে। প্রয়োজনীয় সাহায্য দিয়ে এ বার ৩০ জন চাষিকে বীজ উৎপাদনের জন্য বলা হয়েছে। আশা করা যায়, ৭-৮ কুইন্টাল বীজ উৎপাদিত হবে। যা এলাকার চাষিদের কাজে লাগবে।’’
অন্য দিকে, এমন উদ্যোগের ফলে এলাকার চাষিদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হবে বলে মনে করেন নলহাটি ১ ব্লকের সুলতানপুর কৃষি সমবায় সমিতির ম্যানেজার অসীমকুমার সেন। এলাকার চাষি বাবর হোসেন, গৌতম সাউও মানছেন সে কথা। তাঁরা জানাচ্ছেন, শংসিত বীজ পেতে আর কোথাও যেতে হবে না। নিজেরা বীজ উৎপন্ন করলে লাভও বেশি।