খুলবে হিমঘর, আশায় চাষি

রঙ চটে গিয়ে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছাড়া বাহ্যিক আর কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে না। শুধু বাইরেটা নয়, ভিতরের চিত্রও অভিন্ন নয়। অক্ষত রয়েছে হিমঘরের পরিকাঠামো। যথাযথ যন্ত্রপাতিও। তবুও ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে দুবরাজপুরের চাষিমঙ্গল সমবায় হিমঘরটি।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:৪৯
Share:

প্রতীক্ষার অবসান। দীর্ঘ বারো বছর পরে খুলতে চলেছে এই হিমঘর। —নিজস্ব চিত্র।

রঙ চটে গিয়ে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছাড়া বাহ্যিক আর কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে না। শুধু বাইরেটা নয়, ভিতরের চিত্রও অভিন্ন নয়। অক্ষত রয়েছে হিমঘরের পরিকাঠামো। যথাযথ যন্ত্রপাতিও। তবুও ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে দুবরাজপুরের চাষিমঙ্গল সমবায় হিমঘরটি। দীর্ঘ এক যুগ বন্ধ থাকার পরও প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। জেলা সমবায় দফতর সূত্রের খবর, এ বার সেই চাষিমঙ্গল হিমঘরই পুনরুজ্জীবীত হতে চলেছে।

Advertisement

একদিন নিশ্চই হিমঘর খুলবে, এই বিশ্বাস থেকেই এতদিন যাঁরা রক্ষণাবেক্ষণ করে এসেছেন হিমঘরটি, তাঁদের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের রুজিরুটির সম্পর্ক। হিমঘরের কর্মী, নৈশ প্রহরীর পরিবার এবং হিমঘরকে ঘিরে গড়ে উঠা কোল্ড স্টোর পাড়ার বাসিন্দারা সকলেই সেই এই দলে রয়েছেন। রুজিরুটি হারালেও তাঁরা বিশ্বাস করে হিমঘরটিকে আগলে রাখার পুরস্কার সম্ভবত পেতে চলেছেন। জেলা সমবায় সমিতির উপ নিয়ামক সৌগত সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘হিমঘরটিকে পুনরুজ্জীবীত করার জন্য নাবার্ড প্রায় 50 লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। টাকাও এসে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই অডিট করানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ওই হিমঘরের কোনও বৈধ বোর্ড না থাকায় সেই টাকা কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। এলাকায় থাকা কয়েকটি সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিগুলি থেকে সাত-আট জনের একটি কমিটি গড়ে সেই টাকা কাজে লাগানো হবে। প্রক্রিয়া চলছে।’’ যদিও হিমঘরের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেকেই বলছেন, টাকা বরাদ্দ অনেক আগেই হয়েছিল। প্রশাসনিক তৎপরতার অভাবেই বিলম্ব হচ্ছে। সৌগতবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘প্রথম থেকেই বেশ কিছু জটিলতা ওই সমবায় হিমঘরটিকে ঘিরে ছিল। কোনও দিনই নির্বাচিত বোর্ড ছিল না। বর্তমানেও সেটা না থাকাই সমস্যার মূলে।’’

স্থানীয় ও সমবায় দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বাম সরকারের আমলে তৎকালীন সমবায় মন্ত্রী ও এলাকার ফব বিধায়ক ভক্তিভূষণ মণ্ডলের উদ্যোগে ১৯৭৯ সালে চালু হয় ৪ হাজার মেট্রিকটন ক্ষমতা সম্পন্ন হিমঘরটি। প্রথম প্রথম এলাকায় যে পরিমাণ আলু চাষ হত তা দিয়ে হিমঘরের চাহিদা পূরণ হত না। আলু আনতে হত নির্ধারিত এলাকার বাইরে থেকে। ১৯৯৫ সালে হিমঘরের তত্ত্বাবধানে থাকা সমবায় সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়ে হিমঘরটিকে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট কো-অপারেটিভ এগ্রিকালচারাল রুরাল ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ককে পাঁচ বছরের জন্য লিজ দেয়। তখন অবশ্য ব্যাঙ্কের নাম ছিল সেন্ট্রাল ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক। পরে আরও দু’বছর লিজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। সেই সময় ভালই চলত হিমঘরটি। এলাকার চাষিরাও নতুন উদ্যোমে আলুচাষ শুরু করে ছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালের পর ওই ব্যাঙ্ক আর লিজের মেয়াদ বাড়াতে রাজি হয়নি।

Advertisement

বর্তমানে দুবরাজপুরের ফব বিধায়ক তথা চাষিমঙ্গল সমবায় হিমঘরের প্রাক্তন সভাপতি বিজয় বাগদি বলেন, ‘‘সেই সময় হিমঘর চালানোর মতো পর্যাপ্ত টাকা সমিতির হাতে ছিল না। এবং লিজ বাবদ একটা মোটা অঙ্কের টাকা ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট কো-অপারেটিভ এগ্রিকালচারাল রুরাল ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক না দেওয়ায় চালানো যায়নি হিমঘরটিকে। তখন থেকেই বন্ধ ওই হিমঘর। কিন্তু হিমঘরের অবস্থা ও সম্ভবনা দেখে ফের বছর দুয়েক আগে উদ্যোগ নেয় দফতর।’’ নাবার্ডের প্রতিনিধিরা এসে দেখেন যে হিমঘরটি চালু করার পরিস্থিতিতে রয়েছে। ৪৬ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। উদ্যোগকে সাধুবাদ দিয়েছেন বিজয়বাবু। তিনি বলেন, ‘‘হিমঘর খুললে অবশ্যই খুশি হব। উপকৃত হবেন চাষিরা।’’

কী বলছেন এলাকার চাষিরা? মধুসূদন গড়াই, স্বাধীন কাঁড়ি, রামকৃষ্ণ ঘোষরা বলছেন, হিমঘর কাছাকাছি কোথাও নেই। বর্ধমানের আসানসোল বা বীরভূমের সাঁইথিয়ায় আলু রাখার খরচ পোষাবে না বলে আলু চাষ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমরা। খুললে নতুন করে ভাবব। তাঁরা আরও বলেন, ‘‘এবার আলুর উৎপাদন বেশি হয়েছিল। দাম পাচ্ছিলেন না চাষিরা। আলু হিমঘর জাত করে ভবিষ্যেত দাম পেতে মরিয়া হয়েছিলেন। বণ্ড পাওয়া নিয়েও জলঘোলাও হয়েছিল। দুবরাজপুরের হিমঘর খোলা থাকলে সমস্যা কিছুটা কমত।’’

হিমঘরকে কেন্দ্র করে একটি অস্ত পাড়া গড়ে উঠেছিল। সেই হিমঘর পাড়ার বাসিন্দারাও খুশি। পাড়ার বাসিন্দা, শ্যামলী বাউড়ি, উজ্বল বাউড়িরা বলেন, ‘‘ওখানে কাজ করেই সংসার চালাতাম। চালু হলে বেঁচে যাই।’’ হিমঘরের নৈশ প্রহরীর দায়িত্বে থাকা ক্ষুদিরাম বাউড়ি এবং নন্দ বাউড়িরা আর বেঁচে নেই। কিন্তু নৈশ পাহারার কাজে নিযুক্ত তাঁদের ছেলে দেবাশিস এবং সত্তম বাউড়িরা। তাঁরা বলছেন, আমরা জীবন দিয়ে আগলে রেখেছি হিমঘরটিকে, একটি নাট-বোল্টও খোওয়া যেতে দিইনি। হিমঘর খুললে আমাদের থেকে বেশি আনন্দ আর কার হবে। হিম ঘরের ম্যানেজার ফটিক কবিরাজ বলেন, ‘‘হিমঘর চালু থাকলে স্বচ্ছল ভাবে চলত সংসার চলত। এখন বিকল্প পেশা বাছতে হয়েছে। আবার হিমঘর চালু হলে সুদিন দেখব সন্দেহ নেই। তবে অনেক আগেই খুলে যাওয়া উচিত ছিল।’’

জেলার তৃণমূল নেতা ও রাজ্য সরকারের মৎস্য মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, ‘‘আমরা আসার পরই হিমঘর নিয়ে তৎপর হই। গত সপ্তাহে সমবায় মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষের দিকে। যা সিদ্ধান্ত হয়েছে তাতে সামনের মরসুমেই দুবরাজপুরের ওই হিমঘরে আলু রাখতে পারবেন এলাকার চাষিরা।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement