মহসিনা খাতুন। —নিজস্ব চিত্র।
মাঠের আল পথ দিয়ে দৌড়চ্ছে কিছু লোক। গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা। হাতে বোমার থলে, দিশি বন্দুক। আরও দূরের আকাশ ঢেকে গিয়েছে বোমার ধোঁওয়ায়।
এমন বিপদমাখা পথ দিয়েই রোজ ৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দূর থেকে এই গ্রামে পড়তে আসত মেয়ে। এক সময়ে যে গ্রামই ঘুম থেকে জাগত গোলাগুলির শব্দে। রাতও পোহাত সেই একই শব্দে। দরজা জানালা এঁটে বাড়ির মধ্যে সেঁধিয়ে থাকতেন গ্রামের মানুষ। দিনের পর দিন গ্রামছাড়া থাকতে হয়েছে বহু পরিবারকেও। মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে নানুরের সেই পাপুড়ি গ্রামের হাইমাদ্রাসার ছাত্রী মহসিনা খাতুন। রাজ্যে ৭৭ নম্বর স্থানে থাকা মহসিনা বীরভূমে পেয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর। শুধু মহসিনাই নয়, পাপুড়ির মাদ্রাসা থেকে ভাল ফল করেছে জিন্নাতুন্নেসা, মনিরা খাতুনেরাও।
অথচ রাজ্য-রাজনীতে পাপুড়ি বহু চর্চিত নাম। ওই গ্রামেই বাসিন্দা কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ এবং তাঁর ভাই দাপুটে তৃণমূল নেতা কাজল শেখ। ২০০০ সালে ওই গ্রামেই সাহানেওয়াজের বিএসএফ জওয়ান ভাই শেখ বদিউজ্জামানকে খুন করা হয়। তাঁকে খুনের অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। তার পরেও সাহানেওয়াজের আর এক ভাই রবু শেখ-সহ বহু তৃণমূল ও সিপিএম কর্মী-সমর্থক খুন হন পাপুড়ি এবং লাগোয়া খালা গ্রামে। সেই সময় এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত গোলাগুলির শব্দে সন্ত্রস্ত থেকেছে পরিবেশ। সন্ত্রাসের জেরে এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে সেখানকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা লাটে উঠেছিল।
২০১১ সালের পরে অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছিল। তৃণমূল একছত্র আধিপত্য বিস্তার করায় সিপিএম কার্যত ঘরে ঢুকে যায়। কিন্তু এ বার বিধানসভা ভোটের আগে ফের সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে এলাকা। এলাকার বিদায়ী বিধায়ক গদাধর হাজরা এবং কাজল শেখের গোষ্ঠীদের মধ্যে সংঘর্ষ, গোলাগুলিতে বারবার সন্ত্রস্ত হয়েছে নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকা। সরাসরি পাপুড়িতে গোলাগুলির ঘটনা না ঘটলেও লাগোয়া বাহিরী-পাঁচশোয়া, নাহিনা প্রভৃতি গ্রামের সন্ত্রাসের প্রভাব পড়ে পাপুড়িতেও। ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে ওঠে বহু পরিবার। আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ারও। কিন্তু সন্ত্রাসকে হারিয়ে দিয়েছে পাপুড়ি হাইমাদ্রাসার ফলাফল। এ বার ওই হাইমাত্রাসা থেকে ৩৯ জন মাধ্যমিক দিয়েছিল। চার জন প্রথম বিভাগ-সহ মোট ৩১ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। ৬৮৯ পেয়ে সেরা হয়েছে মহসিনা।
মহসিনা যদিও ইলামবাজারের মেয়ে। বরাবর পড়াশোনায় ভাল ওই ছাত্রীর বাবা মাসেম মোল্লা দোকান চালিয়ে সংসার চালান। মেয়েকে কোথায় ভর্তি করলে ভাল হবে, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। বন্ধু তথা পাপুড়ির হাইমাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল খালেক মল্লিকের পরামর্শে মেয়েকে সেখানে ভর্তি করেন। গত তিন বছর ধরে টানা ইলামবাজারের ভগবতীবাজার এলাকা থেকে পাপুড়ি যাতায়াত করে পড়াশোনা চালিয়েছে মহসিনা। মেধা তালিকায় স্থান হয়েছে শুনে খুশি হলেও তার আশা ছিল আরও ভাল ফল হবে। ইতিমধ্যেই বর্ধমান আল আমিন মিশনে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সুযোগ পেয়েছে সে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায়। সেই লক্ষ্যে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন গর্বিত বাবা মাসেম মোল্লা, মা রওশনআরা বেগম।
মহসিনা না হয় বাইরে থেকে পাপুড়িতে পড়তে যেত। কিন্তু মাদ্রাসার বাকিরা সকলেই ওই গ্রাম ও সংলগ্ন এলাকার ছাত্রছাত্রী। তাদেরই অন্যতম জিন্নাতুন্নেসা পেয়েছে ৫৭৫ নন্বর। তার বাবা আব্দুল অদুদ প্রান্তিক চাষি। পিতৃহীন মনিরা খাতুন আবার পেয়েছে ৫১০ নম্বর। তার মা সাবিনা বিবি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। দুই ছাত্রীই বলছে, ‘‘বাইরের কোনও কুপ্রভাব আমাদের পড়াশোনায় পড়তে দিইনি। তাই আমরা এমন ফল করতে পেরেছি।’’ তাদের অভিভাবকদের দাবি, ‘কাজল ভাই’য়ের জন্যই গ্রামে শিক্ষা ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের কোনও ছায়া পড়েনি। তাই ভাল ফল। ঘটনাচক্রে ওই হাইমাদ্রাসার পরিচালন সমিতির সম্পাদক কাজল শেখ নিজেই। এ দিন ফোনে তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতিতে বিরোধ আছে, থাকবেও। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনকে তার বাইরে রাখার জন্য সব সময় চেষ্টা করেছি। ওই মেয়েগুলোর পাশে আছি।’’
মহসিনাদের এই সাফল্যে খুশি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক পার্থ মাল এবং শিক্ষক আব্দুল খালেক মল্লিক। তাঁরা বলছেন, ‘‘উত্তেজনা যা কিছু সবটাই ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে। মাদ্রাসার গণ্ডির মধ্যে তার কোনও আঁচ পড়েনি। সেই কারণেই এই মাদ্রাসার মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছে পড়ুয়ারা।’’