পরামর্শ: স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের সঙ্গে
বছর দুই আগের ঘটনা। দেশের সেরা সঙ্ঘ সমবায়ের পুরস্কার জিতেছিল দুবরাজপুরের সাহাপুরের মহিলা স্বনির্ভরগোষ্ঠীগুলির মাথায় থাকা আত্মসম্মান সঙ্ঘ। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের কেন্দ্রীয় জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন যে যে মানদণ্ডে সঙ্ঘের কাজ যাচাই করে পুরস্কৃত করেছিল সেগুলির সবকাটাতেই এগিয়ে ছিল আত্মসম্মান সঙ্ঘ। যার নেপথ্যে ছিলেন আটপৌরে গৃহবধূ মর্জিনা বিবি। আত্মসম্মান আর কিছু করার উদ্যমই তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
মাত্র একুশ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়ে তিন সন্তানের হাত ধরে কার্যত রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। পরনের শাড়ি থেকে শিশুদের খাবারের জন্য পাড়ার মহিলাদের দানের উপর নির্ভর করতে হতো তাঁকে। একসময়ের সামান্য সম্পদকর্মী মর্জিনাই এখন দেশের সেরা সঙ্ঘ সমবায়ের কো-অর্ডিনেটর, এলাকার কয়েক হাজার মহিলার প্রেরণা। নিজের প্রতি বিশ্বাস, অদম্য মনের জোর আর কঠোর পরিশ্রমকে সম্বল করে একজন কোথায় পৌঁছোতে পারেন, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দুবরাজপুরের সাহাপুরের মর্জিনা বিবি।
পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে তাঁর জেদ আর উদ্যমের কাছে হার মেনে। সাহাপুরে দাদু আব্দুস সালামের কাছে মানুষ হওয়া। ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। স্বামীর স্বল্প আয়ে কোনও রকমে সংসার চলত। এর মধ্যেই তিন সন্তানের জন্ম হয়। মেয়ে বড় পরের দুটি ছেলে। ২০০৩ সালে ছোট ছেলে যখন মাত্র একচল্লিশ দিনের তখনই ম্যানেনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মর্জিনার স্বামী শেখ ডালিম। শ্বশুরবাড়িতে কেউ না থাকায় ফের মর্জিনা দাদুর কাছেই আশ্রয় নেন। অসুস্থতা, উপার্জনহীনতায় টানাটানির সংসার আব্দুস সালামের। দাদুই মর্জিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাইরে বেরিয়ে কাজ খোঁজার জন্য। কিন্তু কী কাজ করবেন সেটাই যে তখন জানেন না মর্জিনা।
মর্জিনার কথায়, ‘‘চূড়ান্ত অভাবের সময় স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করে দু মুঠো খাবার ছেলেদের মুখে তুলে দেওয়ার কথাই মাথায় এসেছিল। তখনই পাড়ার এক শিক্ষক আমাকে স্বনির্ভর দলে যোগ দিতে পরামর্শ দেন। ২০০৪ সালে একটি স্বনির্ভর (কাজী নজরুল স্বনির্ভর) দলে যুক্ত হই। সেই শুরু।’’
স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য হওয়া ছাড়াও এলাকার একজন সম্পদ কর্মী হিসাবে সাহাপুর পঞ্চায়েত এলাকায় কাজ শুরু করেন তিনি। মর্জিনা বলেন, সেই সময় স্বনির্ভর গোষ্ঠী করার কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। সমাজের মহিলারা হতেন না। এলাকায় বেরোলেই লোকে নানা কথা বলতো। হঠাতই সামান্য আয়ের সম্পদ কর্মীর কাজটাও চলে গেল ২০০৬ সালে। কিছুদিনের মধ্যেই দাদুও মারা গেলেন। ছেলে মেয়েদের নিয়ে চোখের সামনে তখন অন্ধকার মর্জিনার।
কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, বেঁচে থাকার লড়াই। নাবার্ডের একটি কাঁথাস্টিচের প্রশিক্ষণ শিবিরে কাজ শিখেছিলেন। সেই কাজকে আঁকড়ে ধরেই ফের স্বপ্ন বোনা শুরু। নিজে কাজ করার পাশাপাশি বহু স্বনির্ভর দলের মহিলাদের শেখাতেও শুরু করেন। একটু একটু করে ব্যবসাও বাড়ছিল। ওড়িশা, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, অসম-সহ নানা রাজ্যের শিল্প মেলাগুলোতে নিজের হাতের কাজ বিক্রি করতে শুরু করেন। আয়ের দিশা দেখতে পেয়ে আরও অনেকে এগিয়ে আসতে থাকেন। সঙ্গে নতুন নতুন স্বনির্ভর দল গড়ার কাজও চালাতে থাকেন মর্জিনা। অন্য স্বনির্ভর দল ও দলের বাইরের প্রচুর মহিলা এই কাজে উৎসাহী হয়ে এগিয়ে আসেন। একটি এলাকায় এত সংখ্যক দল গড়ে ওঠার পরে সেখান থেকেই সঙ্ঘ সমবায় গঠন। সামনের সারিতে অবশ্যই মর্জিনা। স্বনির্ভর দলে যে ভাবে খেটেছেন একই ভাবে সঙ্ঘ সমবায়কে দাঁড় করাতে উঠে পড়ে লাগলেন। সেক্রেটারি, ডিরেক্টর, কো-অর্ডিনর-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থেকে পথ প্রদর্শক হয়েছেন বহু স্বনির্ভর গোষ্ঠীর। ক্রমশ কলেবরে বেড়েছে আত্মসম্মান সঙ্ঘ সমবায়। এখন ৩৩৪টি স্বনির্ভর দল ওই সঙ্ঘের আওতায়। প্রায় চার হাজার মহিলা সদস্য আছেন।
ব্লক ও জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, দেশের সেরা এই সঙ্ঘ সমবায় নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত। নির্মল বাংলা মিশনে দেড় কোটি টাকার শৌচাগার গড়েছে ওই সঙ্ঘ। এছাড়া সামাজিক বনসৃজন থেকে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারে এগিয়ে ওই সঙ্ঘ। নিজেদের ব্যাঙ্কিং পরিষেবা আছে। সঙ্ঘ সমবায় থেকে তো ঋণ দেওয়া হয়ই। অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গেও পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে ঋণ পাইয়ে দিয়ে মহিলাদের স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করা হচ্ছে আত্মসম্মানের পক্ষ থেকে। সাফল্যের স্বীকৃতিও মিলেছে। কেন্দ্রীয় পুরস্কার পেয়েছে তাঁর গড়া সঙ্ঘ।
তবে মর্জিনার সঙ্ঘ সমবায় যে গতিতে এগোচ্ছে তার পুরস্কার স্বরূপ প্রশাসনিক সহায়তাও যথেষ্টই রয়েছে। জেলা ও ব্লক প্রশাসন পাশে দাঁড়িয়েছে আত্মসম্মান সঙ্ঘের। ১০০ দিনের ব্যতিক্রমী কাজের প্রকল্পে ফ্লাই অ্যাশ ব্রিক তৈরির কারখানাও পেয়েছে আত্মসম্মান। আগামীদিনে ১০০ দিনের কাজ করাতে নোডাল এজেন্সি হিসাবে কাজ করার যোগ্যতামানও অর্জন করেছে আত্মসম্মান। যে কটি সঙ্ঘ সমবায় সহয়াক ধান কিনছে সেই তালিকায় রয়েছে আত্মসম্মান। তবে আত্মসম্মানের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জুড়ে মর্জিনার নাম। মর্জিনা অবশ্য নিজের কৃতিত্ব মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘সরকারের দেওয়া নানা সুযোগ কাজে লাগিয়ে এলাকার মেয়েদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করাই তো সঙ্ঘের কাজ।’’
তবে মর্জিনার এই এগিয়ে যাওয়ার আরও একজনের কৃতিত্ব আছে বলে মনে করেন তিনি নিজেই। দ্বিতীয়বার শেখ জহিরুদ্দিনকে বিয়ে করেছিলেন মর্জিনা। মর্জিনার কথায়, ‘‘ও আমার সত্যিকারের বন্ধু। আমার অসময়ে সর্বক্ষণের সঙ্গী। ও আছে বলে আজ এতটা এগোতে পেরেছি।’’ মর্জিনা আর জহিরুদ্দিনের একটি সন্তানও হয়েছে। জহিরুদ্দিনের উৎসাহেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন। প্রথাগত পড়া, সংসার এ সবকিছুর পরেও সঙ্ঘ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন মর্জিনা। তাঁর কথায়, ‘‘এখানেই থামতে চাই না। আরও অনেক পথ যেতে হবে।’’
গ্রাম্য আটপৌরে ওই বধূর সেই জেদ ও লড়াইকে কুর্ণিশ জানিয়েছে রাজ্য মহিলা কমিশনও। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কলকাতায় ডেকে সম্মান জানানো হয়েছে মর্জিনা বিবিকে।