ঝালদার বিসজর্নের আকর্ষণ জেলারই লোকশিল্প।—নিজস্ব চিত্র
আর পাঁচটা বারোয়ারির মতো নয়। বিসর্জনের শোভাযাত্রা একটু অন্য রকম করার কথা ভেবেছিলেন পুরুলিয়া ও ঝালদার দু’টি পুজোর উদ্যোক্তারা। দিনের শেষে তাঁদের উদ্যোগ প্রশংসা পেয়েছে দুই পুর-শহরের মানুষজনের কাছেই।
শুক্রবার বিকেলে দুর্গা প্রতিমার নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় বঙ্গ ও মানভূমের লোক সংস্কৃতিকে এক স্রোতে মিলিয়ে দিয়েছে পুরুলিয়া রথতলা সর্বজনীন। এ বার পঁচিশ বছরে পা দেওয়ার এই পুজো কমিটি শোভাযাত্রা করেছে শঙ্খধ্বনি আর ঢাকের বোলের মাধ্যমে। অন্য দিকে, ঝালদা সাউথজোন সর্বজনীন এ বার জেলায় বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান জিতে নিয়েছে সেরা প্রতিমা গড়ে। তাদের বিসর্জনের শোভাযাত্রায় ঠাঁই পেয়েছে কাশ্মীরের উরি সেনা ছাউনিতে জঙ্গিগানায় নিহত জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিসর্জনের সময় উদ্দাম মাইকের শব্দে চটুল নাচগান দেখতে অভ্যস্ত মানুষজন। সেখানে এই দু’টি পুজো কমিটির এ বারের ভাবনা চোখ টেনেছে অনেকের।
‘‘শঙ্খধ্বনি আর ঢাকের বোলেই এ বার আমরা মাকে বিদায় জানাব বলে তাঁরা আগাম ঠিক করেছিলেন, জানাচ্ছিলেন রথতলা সর্বজনীনের কাজল দে, পুষ্পা তিওয়ারি, অঞ্জনা দে, স্বাতী সরকারেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘কমিটির সকলেই চাইলেন বিসর্জনের সময় পাড়ার সকলকেই হাজির থাকতে হবে। তাই আর বাড়িতে থাকতে মন চায়নি।’’ শেষ অবধি শুধু পাড়ারই নয়, এলাকার বিভিন্ন পাড়ার কয়েকশো মহিলা শোভাযাত্রায় সামিল নন। স্থানীয় আইনজীবী মানুরানি কুণ্ডুর কথায়, ‘‘এতদিন তো শোভাযাত্রায় আমরা অংশ নিতে পারতাম না. এবার যখন সকলে মিলে বললেন যে থাকতে হবে তখনই মনে হয়েছিল পায়ের তলায় সর্ষে লেগে গিয়েছে. এত আনন্দ পেয়েছি বলে বোঝাতে পারব না. মা-কাকীমা-জেঠিমা-বৌদিদের সঙ্গে পিছিয়ে থাকেনি স্কুল-কলেজের ছাত্রীরাও. তাঁরাও অংশ নিয়েছে
সমান তালে।
পুজো কমিটির সভাপতি শ্রীমন সরকার বলেন, ‘‘বিসর্জন মানেই চোখের সামনে ভাসে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে নাচগান। মানুষ এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন। তাই আমরা ঠিক করি, এ বার একেবারে বঙ্গ সংস্কৃতির রীতি মেনে শঙ্খধ্বনিতেই মাকে বিদায় দেওয়া হবে। একবার বলার পরেই সকলে যে ভাবে শোভাযাত্রায় পা মিলিয়েছেন, সেটা এই শারদোৎসবের বড় প্রাপ্তি।’’ পুরুলিয়ার পুরপ্রধান কে পি সিংহদেওয়ের মন্তব্য, ‘‘এই কমিটিকে অভিনন্দন।’’ এই উদ্যোগের প্রশংসা শোনা গিয়েছে পুরুলিয়ার প্রাক্তন বিধায়ক নিখিল মুখোপাধ্যায় ও সমাজকর্মী আবু সুফিয়ানের গলাতেও। শহরের আর এক পুজো উদ্যোক্তা দেবকুমার দাঁ-এর প্রস্তাব, ‘‘কে কত ভাল বিসর্জন করতে পারে, এ বার থেকে তার একটা প্রতিযোগিতা হোক। তা সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের সহায়ক হবে।’’
ঝালদার সাউথ জোন সর্বজনীনের বিসর্জনের শোভাযাত্রায় আবার উরির শহিদ সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। তাঁদের স্মৃতিতে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’র শিখা উঠছে আকাশে। পিছনে বাংলার বাউল, ছৌ নৃত্য, ঘোড়ানাচ-সহ মানভূম সংস্কৃতির মিশেল দেখেছেন ঝালদার বাসিন্দারা। এ রকম বিসর্জন দেখে একটা ভাললাগার রেশ এখনও রয়ে গিয়েছে এলাকার মানুষের মনে। ঝালদা গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা অপর্ণা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ভাসানের শোভাযাত্রা এ রকমই হওয়া উচিত। যে রকম চড়া মাইকের শব্দ ও নাচ সহযোগে আমরা সচরাচর বিসর্জন দেখতে অভ্যস্ত, এই বিসর্জন তা থেকে একেবারে অন্য রকম।’’ একই মত একাদশ শ্রেণির ছাত্রী শ্বেতা সিংহের। ঝালদার কাউন্সিলর প্রদীপ কর্মকার বলছিলেন, ‘‘নানা লোকনৃত্য সহযোগে এই শোভাযাত্রা আগামী দিনে ঝালদাকে এই ধরনের উদ্যোগে উৎসাহিত করবে আশা করব।’’
কেন এমন ভাবনা?
এই পুজো কমিটির সম্পাদক পঙ্কজ মণ্ডলের কথায়, ‘‘মাইক বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্য সহযোগে শোভাযাত্রা মানুষ কেমন চোখে দেখেন, তা তো আমরা জানি। তাই ধার করা কোনও বিষয় নিয়ে নয়, এ বার আমরা আমাদের সংস্কৃতিকেই শোভাযাত্রায় রাখব ঠিক করেছিলাম। মানুষের ভাল লাগাতেই আমাদের উদ্যোগের সার্থকতা।’’