চাঁদা-শিকারিরা দাপাচ্ছে বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের রাস্তায়

বিল বইয়ের তাড়া হাতে নিয়ে ছেলেগুলো রাস্তা দাপাচ্ছে। তাদের দেখে অধিকাংশ গাড়িই থমকে যাচ্ছে। কেউ বা কোনও ভাবে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর যে সব গাড়ি আটকে পড়ছে, সেই গাড়ির চালক জানলা থেকে মুখ বের করতেই ছেলেগুলোর কড়া গলা— ‘‘পুজো করব। চাঁদা দিন।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বিষ্ণুপুর ও বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৬ ০১:০৮
Share:

ভোর থেকেই বিষ্ণুপুরের বাইপাসে নেমে পড়ছে ওরা। ছবি: শুভ্র মিত্র।

বিল বইয়ের তাড়া হাতে নিয়ে ছেলেগুলো রাস্তা দাপাচ্ছে। তাদের দেখে অধিকাংশ গাড়িই থমকে যাচ্ছে। কেউ বা কোনও ভাবে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর যে সব গাড়ি আটকে পড়ছে, সেই গাড়ির চালক জানলা থেকে মুখ বের করতেই ছেলেগুলোর কড়া গলা— ‘‘পুজো করব। চাঁদা দিন।’’ আগে অনেকগুলো জায়গায় চাঁদা দিতে দিতে অবস্থা কাহিল বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছিলেন চালক। কিন্তু ছেলেগুলো ঝাঁঝিয়ে ওঠায়, আর আপত্তি তোলার সাহস পেলেন না চালক। হাত বাড়িয়ে কয়েকটা টাকা এগিয়ে দিলেন।

Advertisement

বছরের পর বছর রাজ্যের অন্য এলাকাগুলোর মতো বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন রাস্তায় পুজোর সময় এমনটাই চলে আসছে। ইতিমধ্যে পাত্রসায়র থানা এলাকা থেকে জোর করে রাস্তায় চাঁদা তোলার অভিযোগে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু তারপরেও পুজোর চাঁদা তোলার নামে জবরদস্তি করা কমেনি।

বাঁকুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা জানান, দুর্গাপুজোর আগে থেকেই জেলা জুড়ে চাঁদার জুলুম রুখতে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। জোর করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছে অনেকেই। তিনি বলেন, “কোনও পুজো কমিটির বিরুদ্ধে যদি জোর করে চাঁদা তোলার অভিযোগ ওঠে, তা হলে তাদের পুজোর অনুমতি বাতিল করে দেওয়া হবে বলে সব পুজো কমিটিগুলিকে জানিয়ে দেওয়া হয়ছে। সমস্ত থানাই চাঁদার জুলুম রুখতে অভিযান চালাচ্ছে।”

Advertisement

যদিও জেলার কয়েকটি এলাকায় ঘুরতেই বিক্ষিপ্ত ভাবে চাঁদা তোলার নামে জবরদস্তির ছবি উঠে এসেছে। বিষ্ণুপুরের কৃষ্ণবাঁধ থেকে হাঁড়িঘাট মোড় হয়ে সাধারণত পর্যটকেরা মদনমোহন মন্দির দেখতে আসেন। ওই এলাকায় রবিবার অন্তত সাতটি জায়গায় কোথাও গোলাপি, কোথাওবা হলুদ রঙের বিল বই নিয়ে ভোর থেকে কালীপুজোর চাঁদা আদায় করতে দেখা গিয়েছে। পণ্যবাহী ট্রাক থেকে পর্যটকদের গাড়ি কিছুই বাদ পড়ছে না। বিষ্ণুপুরের রাজদরবার এলাকার গুমগড় মোড়েও কিছু যুবককে চাঁদার রসিদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পর্যটকদের গাড়ি দেখলেই পথ আটকে তারা চাঁদা নিচ্ছে।

বাঁকুড়া জেলা লরি ড্রাইভার সংগঠনের বিষ্ণুপুর শাখার সম্পাদক বিজয় ধবলের অভিযোগ, ‘‘চাঁদা তোলার নামে রাস্তায় জুলুমবাজি চলছে। এমনটা চলতে থাকলে গাড়ি চালানোই মুশকিল হয়ে পড়বে।’’ তিনি জানান, বিষ্ণুপুর থেকে সোনামুখী ৩৬ কিলোমিটারের পথ যেতে বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৪৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। তার মধ্যে সোনামুখীর থানার সামনেই ১০০ টাকা দিতে হয়েছে।


বাঁকুড়ায় রেহাই পাচ্ছেন না সাইকেল আরোহীরাও। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

পুজোর মুখ থেকেই বিষ্ণুপুরে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। যাঁরা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে শহরে আসছেন, চাঁদা দেওয়ার জন্য চাপাচাপি দেখে তাঁরাও তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছেন। অনেকেই বলছেন, প্রকাশ্যে কয়েকটা ছেলে রাস্তা দাপিয়ে চাঁদা আদায় করছে। অথচ, পুলিশ-প্রশাসনের কোনও দেখা নেই। কি চলছে! এমনটা জানলে বিষ্ণুপুরে এই সময়ে বেড়াতে আসতাম না।’’ বিষ্ণুপুর শহরের ছোটগাড়ি মালিক ও চালক কল্যাণ সমিতির সম্পাদক সুব্রত সেনও বলেন, ‘‘শহরের মধ্যে দেশি-বিদেশি পর্যটক নিয়ে ঘুরতে গিয়ে চাঁদার জুলুমে আমরা অতিষ্ঠ হচ্ছি। প্রশাসনের তো কোনও নজরই নেই। এমনিতেই পর্যটক আসা কমে গিয়েছে। এখন সবে বেড়ানোর মরসুম শুরু হয়েছে। এই রকম চাঁদার অত্যাচার চললে পর্যটকেরা আর বিষ্ণুপুরে বেড়াতে আসবে না।’’

সেখানেই আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে, পর্যটনের সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত লোকজনের কাছে। তাঁদের মতে, পুলিশ যদি পর্যটকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ করতে কড়া মনোভাব না নেয়, তাহলে পর্যটকেরা এই সময়ে বিষ্ণুপুরে আসা কমিয়ে দেবে। তাতে আখেরে এই শহরের পর্যটনেরই ক্ষতি হবে।

শুধু কি বিষ্ণুপুর শহর, বাঁকুড়া শহরেরও বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তোলা চলছে। মাচানতলা-রামপুর রাস্তায়, বাঁকুড়া গার্লস হাইস্কুলের সামনে কিছু ছেলে রাস্তায় টোটো চালক থেকে দুধ বিক্রেতা, সব্জি বিক্রেতাদেরও পথ আটকে কালীপুজোর নামে চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা দিতে না চাইলে বচসা জুড়ে দিচ্ছে তারা। এতে সঙ্কীর্ণ রাস্তায় গাড়ি আটকে গিয়ে লোকজনের চলাচলের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। একই অবস্থা শাঁখারিপাড়া থেকে সতীঘাট যাওয়ার রাস্তায় দোলতলা এলাকাতেও। এখানেও বাসিন্দাদের প্রশ্ন, পুলিশ-প্রশাসন বলে কি কিছুই নেই? অভিযোগ না জানালে, পুলিশ কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই জুলুমবাজি রুখতে ব্যবস্থা নিতে পারে না?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement