জমায়েত: পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে তৃণমূলের জমায়েত বিষ্ণুপুরে। ভিড় থেকেই বিরোধীদের মনোনয়ন দাখিল করতে দেওয়া হবে না বলে স্লোগান ওঠে বলে অভিযোগ। ছবি: শুভ্র মিত্র
ভোটে লড়া দূর অস্ত্। মনোনয়ন তুলতে গিয়ে বিরোধীদের কারও হাত ভাঙছে, কারও মাথা ফাটছে। শাসকদলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে প্রতিরোধ গড়তে আদর্শের ব্যবধানের বেড়া টপকেই মনোনয়ন দিতে যাওয়ার সময় বিজেপি-র হাত ধরার প্রস্তাব দিল সিপিএম। বিজেপি নেতৃত্বও সেই প্রস্তাবে ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানাচ্ছেন। মনোনয়ন পর্বের প্রথ দু’দিনে রক্ত ঝরা অব্যাহত দেখে বিরোধীদের হাত ধরার কথা জানালেন বাঁকুড়া জেলা সিপিএম নেতৃত্ব।
বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটের প্রথম দফার নির্বাচনে মনোনয়ন তোলার প্রথম দিন সোমবার থেকেই বাঁকুড়ার বড়জোড়া থেকে কোতুলপুর শাসকদলের বিরুদ্ধে রক্তচক্ষু দেখিয়ে লাঠি, রড় নিয়ে বিরোধীদের দমিয়ে রাখার অভিযোগে সরব হয়েছে সিপিএম ও বিজেপি। মঙ্গলবারও বিরোধীদের রক্ত ঝরার খবর মিলিছে বিষ্ণুপুর, তালড্যাংরা, খাতড়া থেকে। জেলার বাকি জায়গাগুলি থেকেও তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগও অব্যাহত।
পরিস্থিতি দেখে বিরোধী নেতাদের বলতে শোনা যাচ্ছে, মনোনয়নই যদি তোলা-জমা না করা যায়, তো ভোটের লড়াই হবে কী ভাবে? এই অবস্থায় অলিখিত জোট গড়ার ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বাঁকুড়ার বিরোধী দলগুলির মধ্যে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে সিপিএম।
এক সময়ে যে সিপিএমের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত বিরোধীরা মনোনয়ন পত্র তোলা ও জমা করতে বাধা দেওয়া ও মারধরের অভিযোগ তুলত, এখন সেই সিপিএমই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য অন্য বিরোধীদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। মঙ্গলবার রাখঢাক না রেখেই বাঁকুড়া জেলা সিপিএমের সম্পাদক অজিত পতি বলেন, “এটা ঠিক, বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। তবে যা পরিস্থিতি শাসকদল কাউকেই মনোনয়ন পত্র দাখিল করতে দিচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে দরকার হলে বিজেপি-সহ সকল বিরোধী দল যদি জোট গড়ে মনোনয়ন জমা করতে যায়, আমাদের কোনও আপত্তি নেই।”
এ দিন দুপুরে বাঁকুড়ার স্কুলডাঙায় সিপিএমের জেলা কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল মনোনয়ন দাখিলকে কেন্দ্র করে জেলা জুড়ে চলতে থাকা হামলা নিয়ে আলোচনা চলছে সিপিএম কর্মীদের মধ্যে।
সেখানে শুধু বাম প্রার্থীদের উপরে হামলাই নয়, বিজেপি কোথায় মার খাচ্ছে, সে ব্যাপারেও খোঁজ চলছিল। অজিতবাবুর মোবাইল ঘন ঘন বেজে উঠছিল। কখনও খবর আসছে, তালড্যাংরায় মনোনয়নপত্র জমা করতে গিয়ে হামলার মুখে পড়েছেন বাম প্রার্থীরা। কখনও খাতড়া ব্লক অফিসে বিজেপি-র উপরে হামলা হয়েছে বলে খবর আসছে। ততই কপালে চিন্তার ভাঁজ হচ্ছিল বাম নেতা-কর্মীদের।
তারই ফাঁকে অজিতবাবু বলেন, “ভোটে লড়াই করার অধিকার সব দলের রয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্যই জোটবদ্ধ হওয়া উচিত সব দলের প্রার্থীদের।” কেবল মুখে বলাই নয়, মঙ্গলবার মনোনয়ন পর্বকে কেন্দ্র করে জেলা জুড়ে যে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে, তা নিয়ে জেলাশাসককে লিখিত ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানানো হয় বামফ্রন্টের তরফে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই চিঠিতে বামফ্রন্টের উপরে হামলার বদলে জেলা জুড়ে ‘বিরোধী দলগুলির’ উপর হামলা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং সব ক্ষেত্রেই যাতে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেই দাবি তোলা হয়েছে বামফ্রন্টগত ভাবে।
তা শুনে বিজেপি নেতাদের একাংশ কটাক্ষ করছেন, ‘‘সিপিএমকে কে নিরাপত্তা দেয় ঠিক নেই, ওরা আবার আমাদের নিরাপত্তা দেবে বলছে!’’ যদিও বিজেপি-র জেলা নেতারা সিপিএমের ডাকে হাত বাড়ানোর কথাতেই সায় দিয়েছেন।
বিজেপি-র বাঁকুড়া জেলা সাংগঠনিক সভাপতি বিবেকানন্দ পাত্র বলেন, “ব্লকে ব্লকে যদি অন্য বিরোধী দলগুলি আমাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ ভাবে মনোনয়ন জমা করতে চায়, সে ক্ষেত্রে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ব্লক নেতৃত্বই নেবেন।” আর বিজেপি-র বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি স্বপন ঘোষ অভিযোগ করেন, “পুলিশ, প্রশাসন এবং তৃণমূল একত্রিত হয়ে বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা করতে দিচ্ছে না। তাহলে বিরোধীরাও একত্রিত হয়ে যদি গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে চায়, তাহলে আপত্তির কিছু নেই।”
সমঝোতা প্রস্তাবে রাজি কংগ্রেসও। জেলা কংগ্রেস সভাপতি নীলমাধব গুপ্ত বলেন, “ভোটের নামে অরাজকতা করছে শাসক দল। এর বিরুদ্ধে যদি সমস্ত বিরোধীরা একজোট হয়, তাহলে আমরা রাজি। আমি সব ব্লক নেতৃত্বকে নির্দেশ দিচ্ছি, কেউ যদি মনোনয়ন জমা দিতে জোটবদ্ধ হতে প্রস্তাব দেয়, তাহলে কংগ্রেস পিছু হটবে না।”
বিরোধীদের এই সমঝোতার চিন্তা-ভাবনাকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি তথা ওন্দার বিধায়ক অরূপ খান বলেন, “সিপিএম বা বিজেপি কোনও দলেরই যে আদর্শ বলতে কিছু নেই, তা এই জোটের চিন্তাভাবনাই প্রমাণ করে দিল।” তিনি যুক্ত করেন, “এই রাজ্যে যা উন্নয়ন হয়েছে, তাতে সমস্ত বিরোধী দল একজোট হয়ে লড়াই করলেও তৃণমূল জিতবে।”