বিভিন্ন মামলা থেকে মুক্তি দিয়ে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ

শবরদের আইনি সাহায্য দিতে কেন্দ্র চালু

রবিবার কেন্দা থানার রাজনোয়াগড় গ্রামে পশ্চিমবঙ্গ শবর খেড়িয়া কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে একটি আইনি সহায়তা কেন্দ্র চালু হয়েছে। শবরদের পাশে নিয়ে এ দিন সিআই (মানবাজার) সুবীর কর্মকার সেটির উদ্বোধন করেন।

Advertisement

সমীর দত্ত

মানবাজার শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৬:৩০
Share:

যে শবরদের নাম পুলিশি খাতায় রয়েছে, সমাজের মূল স্রোতে ফেরাতে তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।

Advertisement

রবিবার কেন্দা থানার রাজনোয়াগড় গ্রামে পশ্চিমবঙ্গ শবর খেড়িয়া কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে একটি আইনি সহায়তা কেন্দ্র চালু হয়েছে। শবরদের পাশে নিয়ে এ দিন সিআই (মানবাজার) সুবীর কর্মকার সেটির উদ্বোধন করেন। উপস্থিত ছিলেন কেন্দা থানার ওসি শেখর মিত্র ও সমিতির কর্মকর্তারা।

এলাকায় কোথাও অপরাধ ঘটলেই শবরদের খোঁজ পড়ত। পুলিশ গাড়ি গ্রামে ঢুকলেই শবর পুরুষেরা গ্রাম ছাড়া হতেন। আড়াই দশক আগেও ছবি এ রকমের ছিল। এখন অবশ্য অনেকটাই বদলেছে। পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলায় ১২,২৭০ জন শবর রয়েছেন। যুবকেরা কাজের জন্য পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে। কেউ আবার সমিতির সহায়তায় চাষ করে অবস্থার উন্নতি করেছেন। শবর জনজাতির মধ্যে শিক্ষার হার এখনও শতাংশের হিসাবে আসে না। তবে শিক্ষার প্রসারের চেষ্টা চলছে। এখন বইখাতা নিয়ে গ্রামের স্কুলে যায় শবর শিশুরা।

Advertisement

শবর সমিতির সভাপতি জলধর শবর, পরিচালক প্রশান্ত রক্ষিতরা বলেন, ‘‘বিভিন্ন এলাকা থেকে শবর মহিলা পুরুষেরা সমিতির অফিসে আসেন। কারও রেশন কার্ড নেই, কারও আধার কার্ড হয়নি। আজকাল এমন লোকজনের সংখ্যাটা বেশ বেড়ে গিয়েছে। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি, অনেকেই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বসবাস করছেন।’’ সমিতি খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, বরাবাজার থানার বাগালবাঁধ গ্রামের এক শবর বাসিন্দার নামে ডাকাতির মামলায় হুলিয়া রয়েছে। প্রায় চার বছর নাম ভাঁড়িয়ে তিনি বসবাস করছেন অন্য গ্রামে। এ দিকে গ্রাম ছাড়া হওয়ায় সরকারি নানা প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন ওই ব্যক্তি। সমিতি ঠিক করেছে, যাঁরা অপরাধ ছেড়ে দিয়ে সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে চান, তাঁদের জন্য আইনজীবী বহাল করে মামলার নিস্পত্তি করার ব্যবস্থা হবে। সুস্থ ভাবে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া হবে। এই জন্যই আইনি সহায়তা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে বলে তাঁরা জানান।

সমিতির কর্মকর্তারা জানান, শবররা চট করে এক জায়গায় থিতু হতেন না। ইদানীং সেই পরিস্থিতিটাও বদলাতে শুরু করেছে। গত দু’-তিন দশকের মধ্যে ছবিটা অনেকটাই পাল্টেছে বলে তাঁদের দাবি। গ্রামে থিতু হয়ে চাষ আবাদ বা দিনমজুরি করে সংসার প্রতিপালন করছেন অনেক শবর। কেউ বাইরে কাজ করে সংসারে টাকা আনছেন।

শবর উন্নয়নে রাজ্য সরকারের কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। তাহলে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বাস করার প্রবণতা বাড়ছে কেন?

প্রশান্ত রক্ষিত বলেন, ‘‘কয়েক দশক আগে যাঁরা বিভিন্ন মামলায় জড়িয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকের নামে ওয়ারেন্ট রয়েছে। ওয়ারেন্ট এড়ানোর জন্যে গ্রাম ছাড়া অন্যতম কারণ। যে কারণে তাঁরা রেশন কার্ড, আধার কার্ড বা অন্য সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন না।’’

জলধর শবর বলেন, ‘‘আগে কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধে শবরদের ব্যবহার করতেন। পরবর্তী কালে সমিতির সংস্পর্শে এসে তাঁরা নিজেদের বদলে ফেলেছেন। কিন্তু আগের অপরাধ জনিত মামলার নিস্পত্তি না হওয়ায় তাঁরা সমাজে সুষ্ঠু ভাবে থিতু হতে পারছেন না। এমনকি ৩৫ বছর বয়সে যে যুবক অপরাধে জড়িয়েছিলেন এখন ৬৫ বছর বয়স হলেও তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আবার মিথ্যা মামলায় অনেককে জড়ানো হয়েছিল। ওই অভিযোগ যে মিথ্যে সেটা প্রমাণ করার জন্যে তো হাজিরা দিতে হবে। অনেকেই ভয়ে সেটা করেন না। ফলে জটিলতা বাড়ে।’’

কতজনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে? নির্দিষ্ট সংখ্যা না হলেও প্রশান্তবাবু জানিয়েছেন, পুরুলিয়া আদালতে এক আইনজীবী শবরদের জন্যে প্রায় বিনা খরচে মামলা লড়েন। তাঁর সেরেস্তাতেই এই ধরণের মামলা রয়েছে ৩০৭টি। তাঁরা জানান, আইনি সহায়তা কেন্দ্রের জন্য সমিতির সঙ্গে মুম্বইয়ের টাটা ট্রাস্টের চুক্তি হয়েছে। মামলায় জড়িত শবরদের তাঁরা এক বছরের জন্য, আপাতত ২০টি মামলার খরচ জোগাবেন। সমিতির কার্যকলাপ দেখে চুক্তির মেয়াদ ধাপে ধাপে আরো বাড়ার আশ্বাস মিলেছে।

পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার জয় বিশ্বাস বলেন, ‘‘রবিবার কেন্দার রাজনোয়াগড় গ্রামে শবর সমিতির অফিসে একটি আইনি সহায়তা কেন্দ্র চালু হয়েছে। যে সব শবরদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে আমাদের আশা এই কেন্দ্রের মাধ্যমে তাঁদের মামলার নিস্পত্তি হবে। সমাজের মূল স্রোতে ফেরাটা সহজ হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement