লণ্ডভণ্ড: রান্নাঘরের এই জানলা ভেঙেই ঢুকেছিল দুষ্কৃতীরা। (ইনসেট) তছনছ ঘর। বুধবার গুরুপল্লিতে। নিজস্ব চিত্র
অমর্ত্য সেনের মামাতো বোনের বাড়িতে চুরির ঘটনা আরও একবার রাতের বোলপুর ও শান্তিনিকেতনের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। চুরি যেখানে হয়েছে, সেই গুরুপল্লি বোলপুর থানা এলাকায় হলেও কয়েক কিলোমিটার দূরত্বেই রয়েছে শান্তিনিকেতন থানা এবং বোলপুর মহিলা থানা। বোলপুর শহর ও শান্তিনিকেতনে গত এক বছরে একাধিক চুরির ঘটনায় শঙ্কিত এলাকাবাসী।
অমর্ত্য সেনের দাদু (মায়ের বাবা) ক্ষিতিমোহন সেনের ভাইপো বীরেন্দ্রমোহন সেন। তাঁরই মেয়ে কাজরী রায়চৌধুরী। সেই সুবাদে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের মামাতো বোন। তাঁর বয়স এখন ৮৩ বছর। বুধবার গুরুপল্লিতে কাজরীদেবীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, রান্নাঘরের জানলার শিক ভেঙে ভিতরে ঢুকেছে দুষ্কৃতীরা। খাবার ঘর লণ্ডভণ্ড। কোথাও চিঠির স্তূপ ছড়িয়ে, কোথায় আলমারির জিনিস পড়ে মাটিতে। পাশাপাশি দু’টি আলমারি খুলে তছনছ করেছে চোরের দল।
এই অক্টোবর মাসেই শান্তিনিকেতন থানার দিগন্তপল্লিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ অক্টোবর, চাঁদা তোলার কথা বলে বাড়িতে ঢুকে ৭৯ বছর বয়সী বৃদ্ধা হৈমন্তী দত্তগুপ্তের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে লুটপাট চালায় এক দুষ্কৃতী। বৃদ্ধার হাত থেকে সোনার দু’টি বালা, নগদ সাত হাজার টাকা, মোবাইল ফোন নিয়ে তাঁকে বাথরুমে বন্ধ করে চম্পট দেয় কর্ণ মণ্ডল নামে ভুবনডাঙার এক যুবক। সেই রাতেই অবশ্য কর্ণকে বমাল ধরে ফেলে শান্তিনিকেতন থানার পুলিশ। ওই ঘটনাতেও এলাকায় হইচই পড়েছিল। কলকাতার বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা হৈমন্তী দত্তগুপ্তের পৈতৃক বাড়ি শান্তিনিকেতনেই। দিগন্তপল্লির এই বাড়িটিতে কখনও একা, কখনও বোনকে নিয়ে থাকতেন। ঘটনাচক্রে তাঁর সম্পর্কের সূত্র মিলেছিল ঠাকুর বাড়ির সঙ্গেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা জয়শ্রী সেনের মেয়ে এই হৈমন্তীদেবী।
এ বার অমর্ত্য সেনের মামাতো বোনে বাড়িতে চুরি। পরপর এ রকম ঘটনায় আশঙ্কায় ওই এলাকার মানুষ। কাজরীদেবীর পড়শিদের বক্তব্য, যে ভাবে জানলার শিক ভেঙে চোর ঢুকে চুরি করেছে, এই অবস্থায় ঘরে একা ওই বৃদ্ধা থাকলে আরও বড় কিছু ঘটতেই পারত। পুলিশের ধারণা, বাড়িতে বয়স্ক মানুষের একা থাকা এবং কেউ না থাকা— দু’টিরই সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। গুরুপল্লির বাসিন্দা মৈনাক সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘ব্যবসায়িক কারণে প্রায়ই বাড়ির বাইরে থাকি কিংবা রাত করে ফিরি। ঘরে স্ত্রী আর বৃদ্ধ বাবা ছাড়া কেউ থাকে না। এই ঘটনা জানার পরে একা রেখে যেতেও ভয় হচ্ছে।’’ বিশ্বভারতীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী তারকেশ্বর মিশ্রের কথায়, ‘‘মেয়ের শারীরিক অসুস্থতার জন্য মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী বাইরে থাকেন। আমাকে প্রায়ই একা থাকতে হয়। পর পর এই জাতীয় ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে। বোলপুরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত ঠুনকো, ভাবা যায় না।’’
বিশ্বভারতীর অনেক ছাত্রীর দাবি, যে রাস্তার উপর কাজরী রায়চৌধুরীর বাড়িটি, সেই রাস্তা ছিনতাইবাজদের আস্তানা। বহুবার পড়ুয়াদের থেকে ব্যাগ, মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এই রাস্তায়। শান্তিনিকেতনের ফার্স্ট গেট দিয়ে ভিতরের রাস্তায় ঢুকে অরশ্রী মার্কেট যেতে এ ছাড়া অন্য কোনও পথও নেই। অথচ সন্ধ্যার পরই সুনসান হয়ে যায় এই রাস্তাটি। গত বছর নভেম্বরে সঙ্গীতভবনের ছাত্রী মেহেলি সাঁইকে এই রাস্তার উপরেই আটকেছিল কয়েক জন দুষ্কৃতী। তাঁর থেকে কিছুই না পেয়ে তাঁকে মারধর করে পালায়। মেহেলির কথায়, ‘‘তখন ওই ঘটনার পর হুলস্থুল হয়েছিল। বেশ কিছুদিন নিরাপত্তারক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার পরে আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। এই রাস্তাতেই চুরির ঘটনা আবার সেটা প্রমাণ করল।’’
স্থানীয়দের অভিযোগ, তাঁরা যেহেতু সব সময় এখানে থাকেন না, যাওয়া-আসা করেন, এই সব এলাকার উপরে পুলিশের নজরদারি তেমন থাকে না। প্রশাসনও উদাসীন। এক বার রাস্তার আলো খারাপ হলে দীর্ঘদিন সেই এলাকা অন্ধকার হয়েই থেকে যায়। বিশেষ করে গুরুপল্লির এই অংশটুকু বেশ অন্ধকার। এর ফলেই আরও বেশি করে সুযোগ পাচ্ছে দুষ্কৃতীরা বলেই তাঁরা মনে করছেন। এই অবস্থায় নিয়মিত পুলিশি টহলদারি এবং আলো লাগানোর দাবি জানিয়েছেন এলাকার মানুষ।
পুলিশ অবশ্য ভরসা দিচ্ছে। জেলার পুলিশ সুপার কুণাল আগরওয়াল বলেন, ‘‘শান্তিনিকেতন লাগোয়া সুনসান এলাকাগুলি নিয়ে কাজ শুরু করেছে জেলা পুলিশ। ইতিমধ্যেই ওই সব জায়গায় বসবাসকারী বয়স্ক মানুষদের একটি ডাটাবেস তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে।’’