সমবায় চালুর দাবিতে গ্রাহক-বিক্ষোভ। —ফাইল চিত্র।
অবশেষে সামান্য হলেও আমানতকরীদের গচ্ছিত টাকা ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিল বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। সপ্তাহে দু’দিন মঙ্গল, শুক্রবার ব্যাঙ্কের একজন গ্রাহক (অ্যাকাউন্ট পিছু) ৫০০ টাকা করে তুলতে পারবেন। আজ, শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে এই প্রক্রিয়া।
কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জানান, ১৭টি শাখা থেকে আড়াই লক্ষেরও বেশি আমানতকারি এই পরিষেবা পাবেন। অন্য দিকে ব্যঙ্কিং সিস্টেম চালু থাকা সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি যেগুলির মূল আমানতের ৭০ শতাংশের বেশি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে জমা রয়েছে, সেগুলিকে মাসে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
লেনদেন শুরু হওয়ার খবরে গ্রাহকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে। একটা অংশ এই পদক্ষেপকে সদর্থক হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক আমানতকারিরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘হোক সামান্য অর্থ। মাসে অন্তত ২০০০ টাকা তো তোলা যাবে।’’ কেউ কেউ এর পেছনে অবশ্য ভোটের চমক খুঁজে পাচ্ছেন। বিশেষ করে ব্যাঙ্কের বড় আমানতকারী ও সমবায় সমিতিগুলি। বড় গ্রাহকেরা বলছেন, ‘‘সামান্য টাকা নিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাতে হবে। বিশৃঙ্খলতাও হতে পারে।’’
এক গ্রাহকের প্রশ্ন, ‘‘যাঁদের ৫০ হাজার বা তার বেশি গচ্ছিত আছে, তাঁরা কত দিনে ওই টাকা তুলবেন ভেবে দেখেছেন?’’ সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিগুলির কর্তৃপক্ষের একাংশ জানাচ্ছেন, প্রচুর সংখ্যক ক্ষুদ্র আমানতকারী তাঁদের কাছে টাকা জমা রেখেছেন ব্যাঙ্কের গ্রাহকেরা যে ভাবে সামান্য টাকা পাচ্ছেন আমাদের ক্ষেত্রে সেটাও হচ্ছে না। ‘‘মাত্র ৫০ হাজার টাকায় কী ভাবে সামাল দেব। সে চিন্তায় রাতের ঘুম উড়েছে’’— বলছেন তিনি।
বস্তুত, দেড় বছর বন্ধ থাকার পরে গত বছরের অক্টোবরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে খোলে বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। কিন্তু ব্যাঙ্ক খুললেও আমানতকারীদের টাকা ফেরৎ দেওয়া শুরু করতে পারেননি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেম চালু করা, ঋণ আদায়ে জোর দিয়ে ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার মতো বেশ কয়েক’টি শর্তপূরণ করলে তবেই মিলবে ছাড়পত্র। তা স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়ায় ব্যাঙ্ক খুললেও স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে পারেনি ব্যাঙ্ক।
গত ২০১৪-র মে মাসের ১৫ তারিখ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল করার পর থেকেই জেলার ১৭টি শাখায় লেনদেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাতে সমস্যায় পড়েন ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৭৪ জন আমানতকারী। ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ৩৫০ কোটি ১২ লক্ষ ৫২ হাজার টাকার ভবিষ্যৎ কী হবে, এ নিয়ে আজানা আশঙ্কা শুরু হয়। শুধু ব্যাঙ্কের গ্রাহকেরা নন, অথৈ জলে পড়ে যান সমবায় ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরশীল জেলার ৩৩১টি সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিও। বিশেষত ১০০টির মতো সমবায় সমিতি যেগুলিতে ব্যাঙ্কিং সিস্টেম চালু ছিল। কেননা সমবায় সমিতিতে গচ্ছিত আমানতের একটা বড় অংশ সমবায় ব্যাঙ্কে রাখার নির্দেশ ছিল। টাকা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে গচ্ছিত থাকায় সমিতিগুলি তাদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক আমানতকারীদের টাকা ফেরৎ দিতে পারছিল না। কবে খুলবে ব্যাঙ্ক, সেই প্রশ্নে এক সময় আন্দোলনও শুরু হয়।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম হল, কোনও ঋণ তথা অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি হওয়া চলবে না। কিন্তু বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছিল, তার ৫২ শতাংশ খেলাপি বা অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হয়। ব্যাঙ্ক বন্ধের সময় যেটা ছিল প্রায় ৬২টি কোটি। একটাই উপায় ছিল, ব্যাঙ্ক বাঁচাতে সরকারি সাহায্য। প্রথমে না দিলেও পরে ব্যাঙ্ক বাঁচাতে কেন্দ্র রাজ্য এবং নার্বার্ডের তরফে মিলিত ভাবে ৭৮ কোটি টাকা দেওয়া হয। তবুও বিভিন্ন কারণে লাইসেন্স দিতে চায়নি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এই নিয়ে মামলা হয়। অবশেষে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আপত্তি উড়িয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছরের ১৫ জুলাই সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। অক্টোবরে ব্যাঙ্ক চালু হলেও লাইসেন্স না দিয়ে শর্ত চাপায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কী শর্ত? প্রথমত অনাদায়ী ঋণ আদায়ে ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনা, কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেম চালু করা, কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পরিকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি।
সেই শর্তগুলি কী পূরণ হয়েছে? লেনদেন শুরু হওয়া কী তা হলে লাইসেন্স পাওয়ার পথ মসৃণ হওয়ার ইঙ্গিত? নুরুলবাবু বলেন, ‘‘হ্যাঁ।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘৩১ মার্চের মধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে থেকে লাইসেন্স পেয়ে যাব, সেটা নিশ্চিত।’’